বসন্ত এসে গেছে। পাহাড়ি গাছগুলো সবুজ হতে শুরু করেছে। গাছে গাছে সুশোভিত সাদা এবং গোলাপী ফুল। গ্রামের কাছাকাছি রেল লাইনের ধারে তাঁবু গেঁড়ে কিছুদিন বসবাসের বন্দোবস্ত করছে ভবঘুরেরা। অভ্যাসমতো বন-বাদাড়ে গিয়ে খাবার সংগ্রহ করছে কিংবা শিকার করছে। মাঝেমাঝে ট্রেনের খুব কাছাকাছি ছুটাছুটি ও খেলাধুলা করছে তাদের ছেলে-মেয়েরা। এমনকি কিছুটা পথ ট্রেনের হাতল ধরে ঝুলে থাকাটাও তাদে জন্য তেমন কঠিন হয় না, কারণ টরেনগুলো অধিকাংশ সময় ঘন্টায় ১০ কিলোমিটারের চেয়ে বেশি গতিতে চলে না। আর ট্রেনের এমন শ্লথ গতি নিয়ে তাই রুমানিয়ার অনেম মানুষই রঙ্গ করে বলেন, চল মিনিবাসে কিংবা পায়ে হেটে যাই, তাতে ট্রেনের চেয়ে বেশ আগেই গন্তব্যে পৌঁছা যাবে। যাহোক, এসব কিছুর মধ্যেই পাখিদের দল খুব মজা করে এবং পরিশ্রমী ভাব নিয়ে নিজেদের বাসা বানাচ্ছে।
মিশকো ও আন্টনও বাসা বানাচ্ছে, তবে সেটা হল ময়লা-আবর্জনার বাসা – যা তাদের ট্রেনের কামরায় বানানো হচ্ছে। অবশ্য তারা আধুনিক এবং পরিবেশ সচেতন হওয়ায় সেগুলো তারা সাথে করেই নিয়ে যাবে। তবে সহযাত্রীদের কেউ সেটা জানতো না বলে এতক্ষণ উভয়েই তাদের নীরব ভৎর্সনা কুড়িয়েছে। এমনকি তাদের দুজনের এমন যাচ্ছে-তাই ভাব, একই কামরায় থাকা অন্য দুই রুমানীয় সহযাত্রীর কাছে এতটাই অসহনীয় হয়ে উঠেছিল – যে তারা এই দুই বিদেশীর প্রতি ঘৃণা ছুঁড়ে দিয়ে সেই কামরা ছেড়েই চলে গেছেন। আবর্জনা, চেঁচামেচি, নাক-কান ফুঁড়ে রাখা, নড়তে থাকা হাত। উহ্, যথেষ্ট। ট্রেনের কামরায় বিয়ারের বোতল, বিস্কুটের ঠোঙ্গা কিংবা স্যান্ডউইচের প্যাকেট ফেলে ময়লার পাহাড় বানানোটা ইউরোপীয় তরুনদের একটা আজব রকমের সুখময় অনুভূতি। এবং এটাও তাদের খুব মজা দেয় যে, সহযাত্রীরা তাদেরকে খুব খারাপ ভাবে, নীরবে ভৎর্সনা করে শেষ পর্যন্ত অতিষ্ঠ হয়ে সেই কামরা ছেড়েই চলে যায়। বেশ তো, আন্টন একা একা ভাবতে থাকে। এসব বুড়া-বুড়িদের সেই মান্ধাতা আমলের রুচি-অরুচির একটা ইতি ঘটতে হবে। আর তার জন্য তাদের এভাবেই মর্মাহত হওয়া উচিত।
ট্রেনটা রুমানিয়ার পথ ধরে ঘন্টার পর ঘন্টা চলতেই থাকে। না লাসলো, না ইউখেনিয়া, আর আন্টন না মিশকো কেউই তাদের গন্তব্যে পৌঁছতে পারে না। বিয়ার আর মানুষের তীব্র গন্ধ গোটা কামরা জুড়ে। সূর্যরশ্মি দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়ে আসছে। লঘু হয়ে যাওয়া ঝড়ো বাতাস মৃদৃমন্দ বায়ু হয়ে ট্রেনের জানালার ফাঁক দিয়ে ভেতরে ঢুকছে। গড়িয়ৈ যাচ্ছে সময়। এখন আর সহ্য করতে পারছে না আন্টন। প্রাণ ওষ্ঠাগত। বিয়ার এবং তার আগে গলা ভেজানো সস্তা সব পানীয় যেন এখন মাথার মধ্যদেকার সব উপকরণকে পেঁজা তুলার মতো ঘূর্ণিপাকে ফেলে দিয়েছে।
অনিচ্ছাসত্ত্বেও আন্টনের দাঁতগুলো কড়মড় করে খিঁচিয়ে উঠল। মনের অজান্তেই গুনগুনিয় ওঠে “তুলা..” আর দৃষ্টি পড়ে টিলার উপর ঘুরে বেড়ানে ভেড়াগুলো উপর। তার তীক্ষ্ণ দৃষ্ঠি রাখাল ছেলেটিকে খুঁজে ফেরে। কিন্তু সে কোথায়? কেন কেউ এই ভেড়াগুলোর দিকে নজর রাখছে না? তাদের তো তাদের মতই কোন এক ভেড়া মার্কা রাখালের দরকার। আবারও সে বিড় বিড় করে ওঠে “তুলা….”। হঠাৎ যেন কিসের আঘাতে চমকে জেগে উঠে সে। যেন পেন্সিলের স্কেচ করা ধুসরতার মধ্যে চরম বৈপরিত্ব। চরম বৈপরিত্ব। পশমগুলো খুবই বেড়ে গেছে।
ট্রেনের পাশ দিয়ে একটি ভাল্লুক হেঁটে চলেছে। সেটিকে দেখে একটি ছোট্ট শিশু বলে মনে হচ্ছে। এটা কি বিশ্বাস করা যায় – নিজেকেই প্রশ্ন করে আন্টন। এবার ট্রেনের সামনে পড়েছে এক উল্লাসকারী দল। গান-বাজনার তালে তালে দলটি ঘন বনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। মনে হল ট্রেনের লাইন থেকেই যেন বেরিয়ে আসল বাদ্য-বাদক দলটি। অথচ ট্রেন ঠিক একই নিয়ম মাফিক যেন দম টানছে আর ছাড়ছে। প্রায় অন্ধকার হয়ে এলো। বক্ষপিঞ্জরের ঠিক ভেতরে কেমন শিহরণ অনুভব করে আন্টন। আর ঠিক তখনই আর কোন হিসাব-নিকাশ না করেই ট্রেনের হাঁটার পথ ধরে দেয়ে দৌড়। এক ঝটকায় দরজা খুলে নিচে লাফিয়ে পড়ে। তবে এসময় ট্রেনটা এতই ধীর গতিতে ছিল যে, এতে তার কোন অসুবিধাই হয়নি। তার দুঃসাহসিক কিছু একটা ঘটানোর বাসনা এখন তুঙ্গে। মদের তীব্রতার প্রকোপ এখন খুব স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। তবে তার বন্ধু মিশকো এসব কিছু টের পায়নি। কারণ সে এরই মধ্যে ঘুমিয়ে পড়েছে। আন্টন পরে তাকে ফোন করে এসব জানিয়ে শহরের মধ্যে কোথাও তারা আবার একসাথে হবে – এমন পরিকল্পনা করে। আর যাহোক, মোবাইল ফোনের যুগ বলে কথা। এখন আর কোন কিছুই কোন সমস্যা নয় – তবে এমন সুখমনয় দিন একবারই আসে – ভাবতে থাকে আন্টন। ট্রেনটা এতই ধীরে চলছিলো যে, সে হয়তো আরেকবার লাফ দিয়ে উঠে যেতে পারতো। অথবা সে হয়তো বারবার এভাবে ওঠানামা চালিয়েই যেতে পারতো।
তবে আন্টনের এই কীর্তি-কলাপ কেউ না কেউ তো অবশ্যই দেখেছে – আন্টন যা করছিল তার সব দেখেছে সেই আঙ্গুল ফোটানো মহিলা ইউখেনিয়া এবং ভালোবাসা নিয়ে আক্ষেপ করতে থাকা লাসলো। তারা সবাই একে অপরের দিকে চেয়ে দেখছে – কিন্তু তিনজনেরই এমন দশা যেন সবাই কোন স্বপ্নের মধ্যে ডুবে আছে। তারা সবাই যেন নিজেদের ঘোরের মধ্যেই নিমজ্জিত এবং কারো প্রতি কারো কোন খেয়াল নেই। লাসলো সারাক্ষণ তার ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাওয়া হৃদয়ের কথা ভাবছে। সারাক্ষণ সে তার নিজের আক্ষেপ ও পরিতাপের মধ্যেই সাঁতরাচ্ছে। ইউখেনিয়ার শুধু খেয়াল যে, সে কোন দায়িত্ব কাঁধে তুলবে না। নিজের ছেলের দায়িত্বই সে যখন নিতে রাজি নয়, তখন অন্য কোন অপরিচিত ব্যক্তির তো আরও নয়, তাতে সে যতই সহানুভূতির উদ্রেককারী হোক না কেন। আন্টন তাকে চোখের পলক মেরে ইশারা করে – তবে সে নিজের ভাগ্য নিয়েও সচেতন। তারপরেই জঙ্গলের দিকে দৌড় দেয়। সে সকাল দেখা পথের কুকুরের আবৃতির ভাল্লুক ছানাটিকে ছোঁয়ার চেষ্টা করে এবং না ভোলা স্মৃতি হাতড়াতে থাকে। এই যাত্রায় যতকিছু সম্ভব, সব সুযোগকেই সে কাজে লাগাতে চায়। আর এই ব্যাপারে সে এবং মিশকো দুজনের প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। স্লোভেনিয়ায় দর্শন শাস্ত্র পড়ার আগেই তার ইচ্ছা ছিল জীবনের সব অভিজ্ঞতা অর্জনের। আর সেটি হল ঘুরে বেড়ানে। সেটা সে সবাই বেশ গর্বের সাথেই বলে বেড়ায়। এমনকি এই কিছুদিন আগেও সে এবং মিশকো দিনের পর দিন বলতে গেলে কোন টাকা পয়সা ছাড়াই ঘুরে বেড়িয়েছে। তারা বলকান দেশগুলো ঘুরে দেখতে চেয়েছে, অথচ এককভাবে কোন দেশের বিশেষ কোন খোঁজ-খবর ছাড়াই। কোন দেশের কী প্রথা, ঐতিহ্য, পশু-পাখি, গাছা-পাল কিংবা ঝুঁকির বিষয় কিছুই তারা জানে না। তবে দুঃখের বিষয় যে, মিশকো ঘুমেই মগ্ন।