মায়া হেলগেট
অনুবাদ: হোসাইন আব্দুল হাই
ট্রামের এই কামরার যাত্রীরা কিছুটা বিব্রত। দুপুর আড়াইটায় মিশকো ও আন্টন বিয়ার টেনে যাচ্ছে। গায়ে নোংরা-জীর্ণ কাপড়-চোপড় এবং মুখমন্ডলের বিভিন্ন জায়গায় ছিদ্র করে অলঙ্কার লাগানো। তার সাথে হেড়ে গলায় চালাচ্ছে গল্প-আড্ডা। হাস্যকর ভাঙ্গাচোরা ইংরেজির মিশ্রণ খুব কানে লাগার মতো। তবে সবচেয়ে বিরক্তিকর ঠেকছে তাদের হাততালির মতো কিছু একটা শব্দ। অদূরে বসে থাকা ৫০ বছর বয়সি লাসলো ঠিক ভেবে পাচ্ছে না – ঐ দুই তরুণতো হাত তালি বাজাচ্ছে না, তাহলে সেই শব্দটা কিসে হতে পারে? তবে আর যাই হোক – রোমানিয়ায় অন্তত আমাদের দেশের কেউ এমন আচরণ করতে পারে না। তারা যে কোন বিদেশী হবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। নিশ্চয় কোন বিদেশী ভ্রমণকারী। কিন্তু এই দুই তরুণ কেন অন্য কোথাও গিয়ে তাদের এমন মধুর বন্ধুত্বের ভাব প্রকাশ করছে না? একবার নাক ঝাড়ছে, তো আরকেবার যেন সর্দি টেনে আকাশের দিকে ছুঁড়ে দিল।
লাসলো অবশ্য অন্য কোন গভীর চিন্তায় মগ্ন। সে একজন প্রাথমিক শিক্ষক এবং আজ সকালে শহরের গির্জায় একটি বড়সড় উৎসব ছিল, যেখানে তার ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে তাকে যেতে হয়েছিল। সেই উৎসব সে আজ একদম গলায গলায় উপভোগ করেছে। আর আজ সকালেই সে আবারও সেই মেয়েটিকে দেখতে পায়। তার ভালোলাগা সেই গির্জার গীতিকার, যে দারুণ বেহালা বাজায়। তাকে দেখার পর থেকেই লাসলো হাত-পা সহ সারা শরীর যে এক ধরণের উত্তেজনা আর আফসোসে কটমটিয়ে উঠছে। সে ভেবে পায় না – এই মেয়েটিকে সে কিভাবে না করে দিয়েছিল? আসলে সেটা ছিল তার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল, যা তাকে এতো বছর ধরে জ্বালিয়ে মারছে। তবে হ্যাঁ, সে তো আসলে তখন আরেকটি মেয়েকে বিয়ে করেছিল। তবে সেই বিয়েটার শুরু থেকেই সেটা কোন বিশ্বস্বত দাম্পত্য জীবন হয়ে ওঠেনি। তার উচিত ছিল সে সময় এই বেহালা বাদক মেয়েটিকে বেছে নেওয়া। কিন্তু তখন সত্যিই সে ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছিল – যে কারণ তাকে এখনও আফসোস করতে হচ্ছে। এটার জন্য সে নিজেই দায়ী।
তার চেহারা ফ্যাকাসে এবং ঠোঁট দুটো কাঁপছে। “আহ সকালটা, সকালটা”, সে ভাবতে থাকে। “সে তো আমাকে এখনও ভালবাসতে পারে। সে যেটা একবার পেরেছিল, আবারও সম্ভব হলে সে সেটা পারবে।” সেটাই তার শেষ সুযোগ – তা সে ভালো করেই জানে। সে আরেকবার তাকে প্রস্তাব করতে চায়। সে যখন তার বেহালা বাজানো শেষ করে, তখনই সে তার সামনে গিয়ে দাঁড়াতে পারে এবং মেয়েটির হাতটি নিয়ে নিজে হৃদপিণ্ডের কাছে ধরতে পারে। মাত্র কয়েক সেকেণ্ডের জন্য সে মেয়েটির কাছে তার যন্ত্রণার কথা জানাতে পারে। আর মেয়েটি যদি সেটা অনুভব করতে পারে, তাহলে সে অবশ্যই তার কষ্ট লাঘব করবে। ট্রামের একই কামরায় বসে থাকা ২৫ বছর বয়সী সুন্দরী তনয়া ইউখেনিয়া ভাবতে থাকে, লোকটার কী হয়েছে? তার সামনে বসে থাকা লোকটির দিকে তাকিয়ে সে বেশ বিব্রত বোধ করছে, যে সারাক্ষাণ তার পা এমনভাবে একটার সাথে আরেকটা বাড়ি খাচ্ছে, যেন সে নিজের উপরেই খুবই ক্ষিপ্ত – যা ইউখেনিয়া আগে কখনই দেখেনি। চেহারা ফ্যাকাসে এবং ঠোঁট দুটো সারাক্ষণ কাঁপছে। অথচ তার দুচোখ যদি ছলছল না করতো তাহলে তার মনে দূরাবস্থা হয়তো কারো দৃষ্টি গোচর হতো না। চরম আক্ষেপ যেন তাকে অনবরত খামচে যাচ্ছে। আর ইউখেনিয়া তার এই আফসোসের ধরণকে খুব ঘৃণার সাথে দেখছে। এই অনুভবটিই মুলত ইউখেনিয়ার সবচেয়ে অপছন্দের। এটা তাকে খুব খেপিয়ে তুলছে। তবে ভাগ্য ভালো যে, সেখানে আরও দুই তরুণ সহযাত্রী আছে। এমন অবস্থায় তাদের অস্বাভাবিক আচরণটাও ইউখেনিয়ার ভালো লাগছে। ঐ দুই তরুণের বয়স কত হতে পারে? মনে হয় বিশের ঘরে হবে। তারা দুজন ট্রামের কামরায় যেভাবে হাউকাউ করছে, ইউখেনিয়ার ইচ্ছা করছে তাদের সাথে যোগ দিয়ে কিছুটা হাল্কা বিনোদন নেওয়ার। এমনকি তাদের সাথে একটু বিয়ারে চুমুক দিলেও মন্দ হতো না। তার বয়স এখন মাত্র পঁচিশ এবং রোমানিয়ায় সাধারণত এই বয়সের বেশ আগের মানুষ দায়িত্বের বোঝা কাঁধে তুলে নিলেও তার বেলায় এমনটি ঘটেনি। সে আসলে এখনও নিজেকে বড় ভাবতে চায় না। তবে মেয়ে হিসেবে তার শিক্ষা এবং ভূমিকাও সে ভুলতে পারে না। তাই তার নিজের ব্যাগেই বিয়ার থাকলেও মানুষের চোখের সামনে এটি গলায় ঠেলে এটার চড়া দিম দিতে সে চায় না। কারণ এর জন্য তার মাকে হয়তো কখনও লজ্জায় পড়তে হতে পারে। কেউ জানে না, যে হয়তো কাছাকাছি কোথাও তার মায়ের কোন পরিচিতজন ঈগলের চোখ নিয়ে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে, আর ইউখেনিয়ার মতো কোন শিকারী পেলেই একবারে ছোঁ দেবে। তার চেয়ে বরং পরিকল্পনা মতো ট্রামের টয়লেটের এক কোনায় গিয়ে এক চুমুক বিয়ারে গলা ভিজিয়ে আসবে। আর তাতে তার নিজের এবং পরিবারে উভয়েরই মুখ রক্ষা পাবে। তরুণ দুইটি মাঝেমাঝে যেভাবে হাতাহাতি করছিল তা ইউখেনিয়ার কাছে বেশ মিষ্টি লাগে। তবে হাঙ্গেরিতে রেখে আসা তার ছোট্ট ছেলেটির সাথে তার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধুর এমন হাতাহাতি বরং অস্বাভাবিক ঠেকত। মাঝেমাঝে মাছের মধ্য দিয়ে যাওয়ার সময় তাদের দুজনের মধ্যেও এমনটি ঘটত। তাদের কাছে অবশ্য সেটা ছিল নির্দোষ কারো উপর হামলার মতো। যাহোক, সে অবশ্য তার ছেলের অভাব বোধ করে না। সে কোন দায়িত্ব নিতে চায় না।