Categories
গল্প লেখালেখি

তেপান্তরের মেয়ে

ড. রিম সাবরিনা সরকার

শেষ মুহূর্তে লাফিয়ে বাস ধরলাম। বাড়িয়ে দেয়া হাতটা এক ঝটকায় ভেতরে টেনে নিলো। নইলে বাসের দরজায় চাপা খাওয়া কেউ ঠেকাতে পারতো না। দরজায় আবার সেন্সর কাজ করে না। নালিশ করতে গেলে ড্রাইভার খ্যাক্ করে ওঠে। সাথে দু’তিনটা চোস্ত জার্মান গালি ফ্রি। তাই এভাবেই চলছে।

টাল সামলে নিয়ে ধন্যবাদ দেয়ার জন্যে চারপাশে কাউকে খুঁজলাম। বাসের ভিড়ে সে কখন মিশে গেছে। ধন্যবাদটা গিলে নিয়ে বাদুড়ঝোলা হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। সোমবারের সাড়ে আটটার ল্যাব মিটিংটা বড্ড ভোগায়। সময় মত পৌঁছোতে পারলে হয়। না চাইতেও বার বার হাত চলে যাচ্ছে ঘড়ির দিকে।

‘কব্জিতে তো ঘড়ি নেই। তাহলে দেখছো কি, বল তো?’। অপ্রস্তুত হেসে আড়ষ্ট মাথা নাড়লাম। ঘড়ি নষ্ট আজ দুই সপ্তাহ। কিন্তু খালি কব্জি হাতড়ে সময় দেখা থেমে নেই। ‘তোমার কোথাও লাগে নি তো?’।

আরে, ঝটকা হাত নয় তো? ভাবনাটা শেষ হবার আগেই হাতটা আরেকবার এগিয়ে এল, ‘বেশি জোরে টানি নি তো আবার? হাই, আমি জিসেল‘। ভাল করে তাকিয়ে দেখি একেবারে খাঁটি বাঙ্গালী চেহারার একটা মেয়ে। উজ্জ্বল শ্যামলা রঙের সাথে কালো চুলের লম্বা বেনীর যুগলবন্দী ভ্রান্তিতে ফেলে দেয়। কেন যেন মনে হচ্ছে এই মেয়ের নাম ফারজানা কি ফারহানা। ভিনদেশী জিসেল নামটা একেবারেই যায় না।

ক’জন নামছে পরের স্টপে। এই ফাঁকে জিসেল চট করে হাত টেনে খালি আসনে বসিয়ে দিল। এই মেয়ের দেখি হাত টানের স্বভাব আছে। অস্বস্তিটা আড়াল করে ভদ্রতার শুকনো হাসি দিয়ে আলাপ পরিচয়ে ইতি টানতে চাইলাম। কিন্তু ওপাশ থেকে সবে শুরু। ‘তোমাকে ইন্সটিটিউটের সেমিনারে দেখেছি। তুমি কি অমুক ল্যাবে কাজ করো?’। মাথা নেড়ে সায় দিয়ে দায় সারতে চাইলাম। মিউনিখ শহরের শেষ প্রান্তে সুবিশাল হেল্মহোল্টজ ক্যাম্পাস। অগুনতি বিভাগ আর শ’খানেক ল্যাব। তার ভেতরে সে যখন আমার ঠিকানা বলতে পেরেছে। তার মানে চেহারায় সে খুব চেনে আমাকে। চিনুক গে, আমার কি।

বাস এসে থেমেছে গন্তব্যে। খালি কব্জিতে স্বভাবসুলভ সময় দেখে আঁতকে উঠে হুড়মুড়িয়ে নামলাম। ব্যাগটা দু’কাঁধে নিয়ে ঝেড়ে দৌড়াতে পারলে দশ মিনিটের হাঁটা পথ পাঁচ মিনিটে উড়িয়ে দিতে পারবো। পেছন থেকে জিসেল বলে উঠলো, ‘আরেহ্, নাম বলে গেলে না যে?’। পড়িমরি ছুটতে ছুটতে দাড়ি-কমা ছাড়া জবাব ছুড়ে দিলাম, ‘সাবরিনা-মিটিং-স্যরি-পরে কথা হব্ব…’। বাতাসে মিলিয়ে গেল বাকিটা।

পরের সপ্তাহ।

‘সে দিন যে বাঁই বাঁই করে দৌড়টা দিলে! তুমি কোন দেশের বল তো? ইথিওপিয়া-সোমালিয়া নয় তো? ওরা কিন্তু অলিম্পিকে সেরকম দৌড়ায়।‘ জিসেলের এক কান ওকান হাসি সমেত কথাগুলো শুনে পিত্তি জ্বলে গেল। সে বকেই চলছে, ‘তোমাকে কিন্তু দেখায়ও ইথিওপিয়ানদের মত, মাইরি’। নির্বিকার গলায় বললাম, ‘ইথিওপিয়ার মেয়েদের চেহারা আমার মত হলে সে দেশের ছেলেদের কপাল খারাপ‘। হো হো করে হেসে উঠলো মেয়েটা, ‘উফ্, সাবরিনা, তুমি দেখি দারুন পাজি। তোমার দেশের ছেলেরাও কি তোমার মত দুষ্টু?‘।

একই রকম নির্লিপ্ত সুরে জবাব দিলাম, ‘দুষ্ট মানে দুষ্ট। একবার বাংলাদেশের ছেলের হাতে পড়ে দেখো। জীবন তামা তামা করে ছেড়ে দেবে‘। জিসেল ঘাবড়ে না গিয়ে উল্টো বললো, ‘হন্ডুরাসের মেয়ে আমি, কোনো দেশের ছেলেকে ডরাই না। এমন ঘাড় মটকানি দেবো না…’। চকিতেই চোখে ভেসে উঠলো, দেশী ভাইয়েরা কোন দূরের দ্বীপদেশ হন্ডুরাসের গাট্টাগোট্টা মেয়েদের হাতে কেনু-গুঁতো খাচ্ছে আর বাবা গো, গেছি রে বলে কোঁকাচ্ছে। কি চমৎকার ছবি। আহা রে।

হাসি-ঠাট্টায় পরিচয়টা জমে উঠতে সময় লাগলো না। জিসেলের ভেতর অদ্ভূত কিছু একটা আছে। কথায় আর হাসিতে তার চারপাশে আলো ঠিকরে পড়ে। জার্মানি আসা অবধি এই ক’মাসে বন্ধু তেমন জোটে নি। স্বভাবটাও ঠিক হল্লা করে বেড়ানো টাইপ না। কারো সাথে দু’টো কথা বললে যে কত হালকা লাগে, সে আনন্দ প্রায় ভুলতে বসেছিলাম। আজ অনেক দিন বাদে মনের বদ্ধ জানালা খুলে দমকা হাওয়া হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়লো যেন।

ঠিক হল সামনে কোনো এক দিন লাঞ্চ করবো ক্যাফেটেরিয়ায়। চুটিয়ে আড্ডা হবে তখন। যাবার সময়ে জিসেল থিয়েটারী কায়দায় তিন বার হাত ঘুরিয়ে একটা বাউ করে ফেললো, ‘আসি। আবার দেখা হবে। ততদিনে তোমার দেশী একটা ছেলে দেখে রেখো। টল, ডার্ক, হ্যান্ডসাম, হাহাহা…’। উত্তরে পুরোদস্তুর আদম ব্যবসায়ীর মত চোখ টিপে কপট আশ্বাস দিলাম, ‘হয়ে যাবে। এক হাতের খেল’।

ল্যাবে একের পর এক্সপেরিমেন্ট চলছে। জিসেলের সাথে লাঞ্চে যাবার ফুরসৎ আর মেলে না। আসতে যেতে দেখা হলে দু’দশ কথা হয়, এই যা। সেদিনও সময়টা টায় টায়। বাস স্টপ থেকে নামলেই বিরাট মাঠ। তেপান্তরের সাইজও বোধহয় এর চেয়ে ছোট হবে। খুব দ্রুত হাঁটছি। হঠাৎ দেখি পাশে জিসেল। সমান তালে পা চালাতে চালাতে বলছে, ‘এই মাইনাস পাঁচে চপ্পল পড়ে ঘর ছেড়েছো কি মনে করে?’। চট করে নিজের পায়ের দিকে তাকিয়ে লজ্জা পেলাম। পাতলা মোজার সাথে ফিতেওয়ালা স্যান্ডেল গলিয়ে চলে এসেছি। গতকালের আঠারো ডিগ্রীর কুসুম কুসুম ওম আজকে এক ধাক্কায় শূন্যের ক’হাত নিচে নেমে গেছে। কচি ঘাসেরা সব গা ঢাকা দিয়েছে তুষারের আড়ালে। ময়না, চড়ুই তাড়িয়ে দিয়ে দাঁড় কাকেরা আবার রো ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। শীতের শেষ কামড়ে বসন্ত পালিয়ে ফুড়ুৎ। কে জানতো এপ্রিলের জার্মান আবহাওয়া এমন ক্ষ্যাপাটে।

শুধু আবহাওয়া নয়, জিসেল মেয়েটাও পাগলাটে গোছের। সে একটু থেমে বুট ঠুকে প্রস্তাব দিলো, ‘বাজি লাগবে?’। দেখি কে আগে মাঠের ওধারের ল্যাম্পপোস্টে পৌঁছায়। পলকা চপ্পল বনাম উইন্টার বুট। এক, দুই, তিন…’। কিছু বুঝে ওঠার আগে জিসেল ছুট লাগালো। হিমেল বাতাসে লাল শাল উড়ছে দুর্বার। আমিও কানটুপি টেনে নিয়ে বাজিতে নেমে পড়লাম। নরম পেঁজা তুলোর পথ ফুঁড়ে ছুটছি ভিন দেশের দুই রাজকন্যা। যেন যে জিতবে সে হবে এই তুষার রাজ্যের নতুন রানী। পাল্লা দিয়ে ছুটতে ছুটতে আশ্চর্য হয়ে জিসেলকে দেখছি। মেয়েটার একটা মারাত্মক রোগ আছে। যার নাম ছেলেমানুষী। বাধ না মানা খিলখিল হাসিটা ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ছে শ্বেতশুভ্র তেপান্তরের ইথারে ইথারে।

দেখতে দেখতে বন্ধু হবার বদলে ভক্ত বনে গেলাম। ক্যাফেটারিয়ার বড় স্ক্রিনে ক্যাম্পাসের খবর ফলাও করে ঘুরপাক খায়। তাতে জিসেলের ছবি ভাসে নিত্যদিন। কখনো কনফারেন্সে প্রাইজ নিচ্ছে, কখনো বা স্টুডেন্ট ইলেকশনে জিতে হাত নাড়ছে। ক্যাম্পাসের তুমুল হ্যাপেনিং লেডি। এক নামে সবাই চেনে। এমন মেয়ের ভক্ত না হয়ে উপায় নেই।

তবে মাঝে মাঝে স্ক্রিন ফুড়ে বেরিয়ে আসে জিসেল। মাঝ শরতের শেষ বিকেল। ক্যাম্পাসে বারবিকিউ পার্টি । পুরোটা গ্রীষ্ম গেল, কোনো খবর নেই। অথচ এই আসি আসি শীতে কি না বারবিকিউ। তাও আবার হলিউডি সিনেমায় বিদেশী ছেলেমেয়েদের যেমন হইহুল্লোড় দেখা যায়, অমনটা নয়। কাগজের প্লেটে গ্রিল করা সসেজ আর প্লাস্টিক কাপে বিয়ার নিয়ে যে যার মত ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে নিচু স্বরে গল্প করছে। আমিও একটা পোড়ানো ভুট্টার উপর মাখন ছেড়ে দিয়ে এ্যায়সা কামড় বসিয়েছি। মুখে পুরে মনটাই বিগলিত হয়ে যাচ্ছে। এমন সময়ে হালুম করে কে যেন ঘাড়ে এসে পড়লো। ‘হেই! কোনায় দাঁড়িয়ে কি খাচ্ছো ওটা? হাপুস হুপুস খেয়ে গেলেই হবে? বাৎচিত করতে হবে না?’। মুখ তুলে দেখি জিসেল। লম্বা ঝুলের কমলা ফ্রকে তাকে পড়ন্ত রোদের আলোর মতই স্নিগ্ধ লাগছে। প্রানখোলা হাসিতে হ্যাঁচকা টানে আমাকে উঠিয়ে ছাড়লো ঘাসের আসন থেকে।

‘সামনের নভেম্বরে সাইন্স স্ল্যাম হবে। নাম দিয়েছি। আসবে কিন্তু।‘ কথা আদায়ের ভঙ্গিতে তাকালো জিসেল। সাইন্স স্ল্যামটা কি বস্তু, সেটা না বুঝেই একটা হ্যাঁ বলে দিলাম। ‘জিসেল, এক সাথে এত কিছু করো কি করে, বলো তো? আমার তো সকাল-সন্ধ্যা এক ল্যাবের কাজ করেই জান বেরিয়ে যায়, ফিউউউহহ্!’।

এক হাতে তুড়ি মেরে আমার কথাটা উড়িয়ে দিয়ে জবাব দিল মেয়েটা, ‘তোমার কি মনে হয়ে দেশ ছেড়ে গড়িয়ে গড়িয়ে এদ্দূর এসেছি কেবল পড়াশোনা আর ডিগ্রি-ফিগ্রি করতে? ছোহ্! আমি এসেছি সব জিতে নিতে। যত কম্পিটিশন-কনফারেন্স আছে, সবটায় নাম লেখাবো। হারি-জিতি ব্যাপার না। কিন্তু লড়তে দারুন লাগে‘। শুনে আমারো দারুন লাগলো। জিসেলের কথাগুলোতে যে পরিমান স্পিরিট আছে, টেবিলের ওপর রাখা বিয়ারের জগেও অত স্পিরিট নেই।

ঘড়ি ধরে ঠিক সাড়ে চারটায় হাজির হলাম। ক্যাম্পাসের সবচেয়ে বড় সেমিনার হল। আসনগুলো কলোসিয়ামের আদলে ধাপে ধাপে ওপরে উঠে গেছে। সাইন্স স্ল্যামের আসর শুরু হবে এখুনি। লাল-নীল ডিস্কো বাতি লাগানো হয়েছে। বেশ সাজ সাজ রব। প্রথম প্রতিযোগী এল। কাজটা কঠিন। দশ মিনিটের ভেতর যার যার গবেষনার খটোমটো জটিল বিষয় পানির মত সরল ভাষায় বলে যেতে হবে। শুধু সরল হলে হবে না, সরসও হতে হবে।

রসের অবশ্য অভাব হল না। তুখোড় সব উপস্থাপনায় তাক লেগে যাচ্ছে একের পর এক। অবশেষে তিন জনের পর জিসেল এল। টম ক্রুজের মিশন ইম্পসিবল ছবির থিম মিউজিকটা ব্যাকগ্রাউন্ডে ছেড়ে আপ ফ্রন্টে সে কি সব আউড়ে গেল, আর লোকেরা এর ওর গায়ে হুমড়ি খেয়ে হাসতে লাগলো। সুদূর হন্ডুরাসের মেয়ের মিশন ‘সাইন্স স্ল্যাম’ এক্কেবারে পসিবল হয়ে ছাড়লো। তুমুল হাততালির ভেতর সেরা তিনের ট্রফিটা হাতে উঁচিয়ে চওড়া হাসিতে মঞ্চ মাতিয়ে হাসছে জিসেল। সামনের সারিতে বসে আমিও পাড় ভক্তের মত হাত নাড়ছি। এই মেয়েটা আসলেই অন্য ধাতুতে গড়া।

সকাল সকাল কাজ শুরু করেছি আজ। ‘শুনেছো খবরটা?’। কারিনের কথায় হাতের খাতাটা টেবিলে নামিয়ে জিজ্ঞাসু তাকালাম। কারিন আর আমি একই ল্যাবের। ‘জিসেল নামের মেয়েটাকে চেনো তো?’। মনে মনে বলি, ‘তা আর বলতে!‘। মুখে বললাম, ‘সে আবার নতুন কোনো প্রাইজ জিতেছে, তাই তো?’। কারিন সামান্য ইতস্তত করে ধীরে ধীরে বলে গেল, ‘না মানে জিসেল আর নেই। কালকে রাতের ঘটনা। লাং এম্বলিজম কেস। বাঁচানো যায় নি’।

স্তব্ধ, হতভম্ব হয়ে গেলাম। লাং এম্বলিজমের মানে কি তা জীব বিজ্ঞানের ছাত্র আমাকে বুঝিয়ে বলতে হয় না। রক্ত জমাট বেঁধে ফুসফুসের ধমনী আটকে নিঃশ্বাস বন্ধ করে দিয়েছে জিসেলের। খবরটা শুনে আমারো নিঃশ্বাস আটকে আসার যোগাড়। এমন উচ্ছল, প্রানবন্ত মেয়েটা অমন ঠুস্ করে মরে গেল? মানতেই পারছি না। আরো কিছু জানতে চাইবো বলে মুখ খুললাম। তার আগেই কারিন হাত নাড়ালো, ‘আর কিছু জানি না বাপু। কাজ আছে। যাই গে‘।

জীবিত লোক দিয়ে কাজ হয় গবেষনা চলে, সব হয়। কিন্তু মরে গেলে সে লোক বড়ই অপ্রয়োজনীয় জড়বস্তুতে পাল্টে যায়। তাকে নিয়ে কথা বলাও বাতুলতা। তাই বাজে বকা এড়াতে দায়সারা কাঁধ ঝাঁকিয়ে সরে পড়লো কারিন। শুধু দাঁড়িয়ে রইলাম আমি। হাতের খাতাটা কখন যে ছিটকে পড়ে টেবিলের নিচে পালিয়েছে, খেয়ালও হলো না। বজ্রাহত হলেও বুঝি লোকে জমে এমন কাঠ হয়ে যায় না।

কিন্তু না। জিসেল চলে গিয়ে গেল না। বাক্সবন্দী হয়ে হাসপাতালের মর্গে শুয়ে থাকলো দিব্যি হাত ভাঁজ করে। তার যাওয়া আটকে গিয়েছে। জার্মানি থেকে কফিন তার দেশ হন্ডুরাসে নিতে ম্যালা খরচ। প্রায় হাজার দশেক ইউরো। বাংলা টাকায় লাখ দশেক। পড়তে আসা বিদেশী ছাত্রে ব্যাংকে এত পয়সা থাকে না। শুনলাম জিসেলের পরিবারও তেমন স্বচ্ছ্বল না। মেয়েকে বাড়ি আনার সাধ থাকলেও সাধ্য নেই। বাকি রইল এই হেল্মহোল্টজ রিসার্চ সেন্টার। তাদের মৌনতা সম্মতির লক্ষন হয়ে ধরা দিল না।

দায়টা হাত ঘুরে শেষ মেষ জিসেলের ল্যাবের কলিগদের ঘাড়েই বর্তালো। তারা রোজ রোজ ক্যফেটেরিয়ার দরজায় টেবিল পেতে বসে থাকে। আমরা যে যা পারলাম দিয়ে দিলাম পকেট উজাড় করে। কারিনকেও দেখলাম অবলীলায় অনেকগুলো নোট ঢুকিয়ে দিল ওদের টিনের কৌটায়।

সপ্তাহ খানেক পর। সময়ের সাথে শোক শুকিয়ে যায় অনেকটাই। ব্যস্ত সমস্ত হয়ে ল্যাবে ঢুকেছি। কারিন থামালো হঠাৎ। ‘আজকে জিসেলের ফ্লাইট’। বলেই সে স্বভাবসুলভ কাঁধ ঝাঁকিয়ে বেরিয়ে গেল। সাথে সাথেই প্লেন উড়ে যাবার শব্দ কানে আসলো। এক দৌড়ে জানালার কাছে চলে এলাম। বিচিত্র অস্থিরতা কাজ করছে। নাহ্ব, তাজা বাতাস দরকার।

ক্যাম্পাসের বড় মাঠের এক ধারে বসেছি। তাজা হাওয়ার কানাকানি। তবু যেন বুক ভরে শ্বাস নেয়া যাচ্ছে না। আরো একটা দু’টো প্লেন উড়ে যাচ্ছে দূর আকাশে। কে জানে তার কোনটায় চেপে জিসেল দেশে ফিরছে। আহা, বাক্সে করে হলেও মেয়েটা বাড়ি ফিরুক।

আকাশের নীল থেকে চোখ নামিয়ে ঘাসের সবুজে দৃষ্টি ছুড়লাম। নিমিষেই যেন ঘাসগুলো ঢেকে গেল নরম তুষারে। অস্পষ্ট একটা ছবি ভেসে উঠলো। তুষার মাড়িয়ে লাল শাল উড়িয়ে ছুটে মিলিয়ে যাচ্ছে জিসেল। আর তার প্রানখোলা হাসিটা যেন তরঙ্গ তুলে আস্তে আস্তে ছড়িয়ে পড়ছে তেপান্তরের আনাচে কানাচে।

লেখিকা: পোস্ট-ডক্টরাল গবেষকঃ স্কুল অব মেডিসিন, টিইউ মিউনিখ, জার্মানি