Categories
প্রবন্ধ প্রবাস ব্লগ লেখালেখি

জার্মান সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা কতটুকু সুরক্ষিত?

কাউসার উল হক

©Thorben Wengert_pixelio.de

ইউরোপের সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশ জার্মানির সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা বেশ উন্নত। এটি সম্ভব হয়েছে সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থায় তাদের ব্যয় বৃদ্ধির ফলে। প্রায় সাড়ে আট কোটি জনসংখ্যার এই দেশ সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থায় জিডিপি এর এর ২৮.৩০ শতাংশ অর্থ ব্যয় করে।

নাগরিকদের জীবন, জীবিকা, ও সু-স্বাস্থ্যের নিশ্চয়তা প্রদানের জন্য পৃথিবীর প্রায় সকল দেশেই সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা রয়েছে। সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা হলো জীবনব্যাপী মানুষের দরিদ্রতা ও অসহায়ত্ব দূরীকরণে রাষ্ট্রীয়ভাবে গৃহীত কিছু কার্যক্রম ও নীতিমালা। অর্থাৎ, জন্ম থেকে মৃত্য পর্যন্ত মানুষের আর্থিক, শারীরিক, ও সামাজিক নিরাপত্তা প্রদানের জন্য যেসব সেবা, যেমন অবসরভাতা, স্বাস্থ্যসেবা, বেকারভাতা, মাতৃত্বকালীন সেবা সরবরাহ করা হয় তাদের সমষ্টিই সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা।

ইউরোপের দেশগুলোর সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা বেশ মজবুত। এটি সম্ভব হয়েছে সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থায় তাদের ব্যয় বৃদ্ধির ফলে; প্রতিটি দেশ মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির শতকরা ১৫-৩০ ভাগ এ খাতে খরচ করে। বিশ্ব শ্রম সংস্থার মতে, একটি সর্বাঙ্গীন উন্নত ও কার্যকরি সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য প্রতিটি দেশের জিডিপির এর ৩০ শতাংশ খরচ করা উচিত।

ইউরোপের সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশ জার্মানির সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা বেশ উন্নত। প্রায় সাড়ে আট কোটি জনসংখ্যার এই দেশ সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থায় জিডিপি এর এর ২৮.৩০ শতাংশ অর্থ ব্যয় করে। এই বিশাল ব্যয়ের প্রধান উদ্দেশ্য নাগরিকদের বেকারত্ব, বিকলাঙ্গতা, অসুস্থতা, ও আর্থিক অসহায়ত্ব থেকে সুরক্ষা দেওয়া। সামাজিক নিরাপত্ত্বা সুবিধাসমূহ পেতে কোন ব্যাক্তিকে জার্মানিতে বৈধভাবে বসবাস করতে হবে, অথবা জার্মান নাগরিক হতে হবে।

জার্মানির সামাজিক নিরাপত্ত্বা সেবাসমূহকে দুইটি শ্রেণীতে ভাগ করা যায়। একটি সামাজিক বীমা, অপরটি সামাজিক সহায়তা।

©Rainer Sturm_pixelio.de

সামাজিক বীমা: এর সুবিধাসমূহ পাওয়ার জন্য নাগরিকদের মাসিক আয়ের একটি নির্দিষ্ট অংশ সামাজিক নিরাপত্ত্বা ব্যবস্থায় অবদান রাখতে হয়। এটি জার্মান সামাজিক নিরাপত্ত্বা ব্যবস্থার একটি সংবিধিবদ্ধ নিয়ম যেখানে সকল চাকুরীজীবী এই ব্যবস্থার আওতাভুক্ত এবং বাধ্যতামূলকভাবে অংশ গ্রহণ করে। সামাজিক বীমা ব্যবস্থা পরিচালনার জন্য জার্মানিতে বসবাসরত প্রত্যেক ব্যক্তির একটি সামাজিক নিরাপত্ত্বা নম্বর থাকে। চাকরিতে যোগদানের পূর্বে নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানকে এই নাম্বার সরবরাহ করতে হয় এবং মাস শেষে মূল বেতন থেকে বিভিন্ন নিরাপত্তা-সেবার অবদান কেটে নেওয়া হয়। জার্মান সামাজিক সেবার স্তম্ভ পাঁচটি। এগুলো হলো; স্বাস্থ্য বীমা, অবসর ভাতা, বেকারত্ব বীমা, দীর্ঘমেয়াদি তদারকি বীমা, এবং দুর্ঘটনা বীমা।

স্বাস্থ্য বীমা: জার্মান সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সেবা এবং জার্মানিতে বসবাসকারী সকল ব্যক্তির জন্য বাধ্যতামূলক। একজন ব্যক্তি সরকারী বা বেসরকারি যে কোন স্বাস্থ্য বীমার অন্তর্ভুক্ত হতে পারেন এবং অসুস্থতার সময় ডাক্তার দেখানো, হাসপাতালে খরচ, থেরাপি, ও ঔষধসহ চিকিৎসার যাবতীয় ব্যয়ভার বীমা বা ইনস্যুরেন্স কোম্পানি বহন করে। স্বাস্থ্যবীমার মাসিক অবদান ব্যক্তির মূল বেতনের ১৪.৬%, যার অর্ধেক ব্যক্তি বহন করেন, বাকী অর্ধেক চাকরীদাতা প্রতিষ্ঠান পরিশোধ করে।

অবসর ভাতা: এটি ৬৫ বছরের উর্ধ্বে অবসরপ্রাপ্ত নাগরিকদের আর্থিক নিরাপত্ত্বার জন্য গৃহীত ব্যবস্থা। চাকরিরত অবস্থায় প্রত্যেক কর্মচারি সরকারি পেনশন ইনস্যুরেন্সে মূল বেতনের ১৮.৬% (৯.৩% ব্যক্তি এবং ৯.৩% চাকরি দাতা প্রতিষ্ঠান) অবদান পরিশোধ করে। অবসর গ্রহনের পর ব্যক্তি পেনশনের সুবিধা পেয়ে থাকে, যার পরিমাণ নির্ভর করে কর্মরত অবস্থায় ব্যক্তির পরিশোধকৃত মোট অবদানের ওপর।

বেকারত্ব বীমা: এই বীমা বেকার নাগরিকদের আর্থিক নিরাপত্তা প্রদান করে। তাই চাকরিরত অবস্থায় সকল ব্যক্তিকে মূল বেতনের ২.৪% বেকারত্ব বীমায় জমা রাখতে হয়। সাধারণত চাকরীচ্যুত ব্যক্তি নতুন চাকরী খোঁজা সাপেক্ষে ৬ মাস থেকে সর্বোচ্চ ২ বছর পর্যন্ত পূর্ববর্তি মূল বেতনের ৬০% বেকার ভাতা হিসেবে পেয়ে থাকেন।

দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্য সেবা বীমা: অসুস্থতা কালীন কোন ব্যক্তির গৃহ-শুশ্রূষা, বা গৃহ-পরিচারিকার প্রয়োজন হলে তার সুবিধা নিশ্চিত করে। এই সেবার জন্য ব্যক্তি এবং চাকরিদাতা মূল বেতনের ১.৫২% চাঁদা পরিশোধ করেন। ১৯৯৫ সালে এই নতুন বীমা চালুর মাধ্যমে নাগরিকদের সামাজিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বিদ্যমান এই ঘাটতির অবসান ঘটানো হয়।

সামাজিক সহায়তা: সামাজিক সহায়তা পাওয়ার জন্য নাগরিকদের সরাসরি আর্থিক অবদান রাখতে হয় না। রাষ্ট্র কর্তৃক ট্যাক্সের অর্থ দিয়ে এই সেবাগুলো প্রদান করা হয়। জার্মানিতে শিশু-কিশোর, পরিবার, ও প্রতিবন্ধীদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ, এবং আর্থিক নিরাপত্তার জন্য বেশ কিছু সেবা প্রদান করে জার্মান সরকার। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:

শিশুভাতা: শিশুরা প্রকৃতির চমৎকার উপহার। শিশুদের খাবার, জামা-কাপড়, খেলনা, ও শিক্ষার জন্য অর্থের প্রয়োজন। শিশু-ভাতা শিশুর সুস্থ বিকাশ ও সুষ্ঠভাবে বেড়ে উঠতে সহায়তা করে। জার্মানিতে সকল বাবা-মা সন্তানের জন্য শিশু ভাতা পান। একজন শিশুর জন্য যে কোন একজন ব্যক্তি; শিশু যার সাথে থাকবে বাবা-মা, কিংবা দাদা-দাদী, তিনি এই সুবিধা নিতে পারবেন। শিশু-ভাতা সাধারণত শিশুর ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত দেওয়া হয়। তবে কিছু ক্ষেত্রে যেমন, কারিগরি শিক্ষা চলমান, বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক শ্রেণীতে শিক্ষারত থাকলে এটি ২৫ বছর পর্যন্ত হতে পারে।

২০২২ সালের হিসেব অনুযায়ী, প্রথম দুই সন্তানের জন্য প্রতি মাসে ২১৯ ইউরো, তৃতীয় সন্তানের জন্য ২২৫ ইউরো, এবং চতুর্থ ও পরবর্তি সন্তানদের জন্য ২৫০ ইউরো শিশু-ভাতা দেওয়া হয়। অর্থাৎ সন্তান বেশী হলে আর্থিক সুবিধাও বেশী।

পিতামাতার ভাতা: সন্তানেরজন্মের পর থেকে তার লালন-পালন ও দেখভালের জন্য পিতা-মাতা দু’জন বা যে কোন একজন এই ভাতা পেয়ে থাকেন। সন্তানের জন্মলাভের পর চাকরী থেকে ছুটি নেওয়া সাপেক্ষে অথবা সপ্তাহে ৩০ ঘন্টার কম কাজ করলে ১২ থেকে ১৪ মাস এই ভাতা পাওয়া যায়। এই মাসগুলো শিশুর পিতা এবং মাতা সুবিধা অনুসারে নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিতে পারেন। পিতামাতার মধ্যে যে কোন একজন সর্বনিম্ন দুই মাস থেকে সর্বোচ্চ ১২ মাস পর্যন্ত ছুটি নিতে পারেন। পিতামাতার কেউ যদি একাকী শিশুকে লালন-পালনের দায়িত্ব পালন করেন, তাহলে একাই পুরো ১৪ মাস পর্যন্ত কাজ থেকে ছুটি নেওয়া সাপেক্ষে এই ভাতা নিতে পারবেন। এই সুবিধা শুধুমাত্র শিশুর জন্ম থেকে ১৪ মাস বয়স পর্যন্ত সময়ের মধ্যেই নেওয়া যাবে।

মাতৃত্বকালীন ভাতা: সন্তান জন্মের ছয় সপ্তাহ আগে থেকে জন্মের আট সপ্তাহ পর পর্যন্ত মাতৃত্বকালীন ছুটি পেয়ে থাকেন প্রসূতি মায়েরা। জমজ সন্তান জন্মের ক্ষেত্রে এবং নির্ধারিত সময়ের আগে সন্তানের জন্মের ক্ষেত্রে মাতৃত্বকালীন ভাতা প্রাপ্তির মেয়াদ সন্তান প্রসবের দিন থেকে আট থেকে বারো সপ্তাহ পর্যন্ত বৃদ্ধি হতে পারে।

পিতৃত্বকালীন ছুটি: যেসব বাবা-মা নিজেরাই সন্তান লালন-পালন ও দেখভাল করেন তাদের জন্য এই ছুটি প্রযোজ্য এবং এটি ছুটি চলাকালীন চাকরীর নিরাপত্ত্বা নিশ্চিত করে। বাবা অথবা মা যে কোন একজন অথবা দু’জন ভাগাভাগি করে সর্বোচ্চ ৩ বছর পর্যন্ত এই ছুটি নিতে পারবেন। এই ছুটির বিশেষ দিক হচ্ছে, সন্তানের ৩য় জন্মদিন থেকে ৮ম জন্মদিনের মধ্যে ২৪ মাসের ছুটি নেওয়া যাবে। অর্থাৎ পুরো তিন বছর ছুটি এক সাথে না নিয়ে বিভিন্ন সময়ে নেওয়া যায়।

প্রতিবন্ধী সুবিধা: প্রতিবন্ধীদের জন্য যে কোন সরকারী ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে যদি ২০টির বেশী পদ থাকে, শতকরা ৫% পদ বরাদ্দ রাখতে হবে। গুরুতর প্রতিবন্ধী ব্যক্তি বছরে পাঁচ দিন বেশী বৈতনিক ছুটি পাবে। একজন প্রতিবন্ধী ‘অক্ষমতাছাড়’ এর মাধ্যমে আরো কিছু সুবিধা পেতে পারে যেমন, ট্যাক্স মওকুফ, সীমিত যানবাহন ট্যাক্স, পার্কিং ফী মওকুফ, রেডিও ও টেলিভিশন ফী মওকুফ, এবং পাবলিক যানবাহনে ফ্রি যাতায়াত।

আবাসন ভাতা: আবাসন ভাতার উদ্দেশ্য হলো মানুষ যেন পর্যাপ্ত জায়গা নিয়ে পরিবার-বান্ধব পরিবেশে বসবাস করতে পারে। আবাসান ভাতা বাসা ভাড়ার সহযোগিতা হিসেবে ব্যক্তিকে অথবা বাড়ির মালিককে দেওয়া হয়। উপরে উল্লিখিত সুবিধাসমূহ ছাড়াও জার্মান সামাজিক নিরাপত্ত্বা ব্যবস্থায় শিশুদের জন্য ভর্তুকি, বিশেষ পরিস্থিতিতে সহায়তা, ন্যুনতম আর্থিক সহায়তাসহ আরো কিছু সুবিধা প্রদান করা হয়। জার্মান সরকারের উচ্চমাত্রার ও প্রগতিশীল কর নীতির মাধ্যমে অধিক রাজস্ব আয়ের ফলে এসব সুবিধা দেওয়া সম্ভব হয়।