শ্যার্শ পালাজি
বৈশ্বিক এবং সামাজিক পর্যায়ে আজ যে বৈষম্য বিরাজ করছে সেটা ব্যাখ্যা করতে হলে প্রথমে একটু অতীতের দিকে নজর ফেরাতে হবে।
জার্মানির উপনিবেশকাল শুরু হওয়ার অনেক আগে থেকেই কলোম্বাস এবং তার সাঙ্গপাঙ্গদের কল্যানে পশ্চিমা জগত উন্নয়ন এবং সুনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে যাত্রা শুরু করে। তবে সেটা সম্ভব হয়েছিল অন্য জাতিকে শোষণের বিনিময়ে। উপনিবেশের সম্প্রসারণকে লক্ষ্য করেই বর্ণবাদের শুরু হয় যেটা পশ্চিমাদেরকে এক ধরণের নৈতিক সমর্থন জুগিয়েছিলো। এটা গড়ে ওঠে অতলান্তিকের দু’পাশে সর্ববৃহ মানব পাচারকে কেন্দ্র করে। জার্মানির প্রথম বাণিজ্যিক গোষ্ঠীটি গড়ে উঠেছিলো এই মানব পাচার পরিচালনা করার জন্য। যারা মনে করে, কেবল সংগঠন এবং উদ্ভাবনী শক্তির কল্যাণে আজকের ‘উন্নত বিশ্ব’ তৈরি হয়েছে, যারা সম্পদের অসম বন্টনকে এড়ানোর চেষ্টা করতে চায়, তারা আসলে ঐসব ‘অনুন্নত’ দেশের প্রতি তাদের ঐতিহাসিক দায়টা অস্বীকার করে।
এই বিষয়টা আমাদের জার্মানির বর্তমান প্রজন্মের সহাবস্থানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ‘অনুন্নত’ বিশ্বের প্রতি এই নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গীর দায় কিছুটা অশ্বেতাঙ্গ নাগরিকদের ওপরও বর্তায়। যদি উপরোক্ত অসম বন্টনের বিষয়টি কারো নজরে না পড়ে তাহলে একজন সাধারণ মানুষ যখন মনে করে আফ্রিকা কিংবা এই ধরণের দেশগুলোর দুর্দশার জন্য তারাই দায়ী তাদেরকে খুব একটা দোষ দেওয়া যায় না। এই ধরণের মানুষ ‘অনুন্নত’ দেশের প্রতি কিংবা সেসব দেশ থেকে আগত অভিবাসীদের সন্তানদের প্রতি কিছুটা সহানুভূতি দেখাতেই পারে।
‘উন্নয়ন’ শব্দটির মধ্যেই সমস্যা রয়েছে। কারণ এটা বাণিজ্যকি বিনিময়ের যে সামাজিক এবং পরিবেশগত পরিণাম রয়েছে সেটা আমলে নেয় না। একই কথা খাটে শরণার্থী এবং অভিবাসন কথাটার মধ্যেও। বৈশ্বিক দক্ষিণ গোলার্ধে্ আজ যে অভিবাসনের স্রোত তৈরি হয়েছে তা হয়েছে উপনিবেশিক আমলের অন্যায্য বাণিজ্যিক কাঠামোর কারণে। উপনিবেশ না ঘটলে শিল্পায়ন এবং মানব সৃষ্ট পরিবেশ বিপর্যয়ের চেহারা আজ অন্যরকম হতো।
যদি ইতিহাসের এই ঘটনাগুলোকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করা হতো তাহলে আমাদের সমাজে আজ যে ‘অর্থনৈতিক শরণার্থী’ কথাটি প্রচলিত আছে সেটা গ্রহণযোগ্য হতে পারতো না। এবং জলবায়ু বিষয়ক অবিচারগুলোও আমরা আজ ভিন্নচোখে মূল্যায়ন করতাম।
কিন্তু এইসব কথা বলতে গেলেই বলা হয়, ”এগুলো তো সব অতীত, এগুলো এখন বলে আর কী হবে”। এই ধরণের কথা যারা বলে তারা জানে না যে আমরা এখনও উপনিবেশ আমলের বিভিন্ন বৈষম্য মোকাবিলা করছি। জার্মানির মানুষের মধ্যে এখনও সেই উপনিবেশ আমলের অনেক বিষয় রয়ে গেছে। এখনও জার্মানির অনেক রাস্তাঘাটের নাম উপনিবেশ আমলের নিষ্ঠুর শোষকদের নামে রয়ে গেছে। সেই আমলের লুট করা বহু জিনিষপত্র এখনও দেখা যায় জার্মানির বিভিন্ন যাদুঘরে। এই বিষয়ে যাদুঘরগুলোর খুব অনীহা। বিগত ২০২০ সালে কোলন শহরের যাদুঘর তাদের তথাকথিত বেনিন ব্রোঞ্জ নামে শিল্পকর্ম ফেরত দিতে বাধ্য হয়। তবে এই ঘটনা এখনও একটা ব্যতিক্রম হিসেবে রয়ে গেছে।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং গণমাধ্যমে এমনকি রাজনৈতিক মহলেও বর্ণবাদমূলক কথাবার্তা শোনা যায়। যেমন কিন্ডাগার্টেনের কথাই ধরা যাক, যেখানে এখনও কলোম্বাসের ঘটনা শোনানো হয়। এমন আরও অনেক ঘটনা এইসব শিশুদের বইতে রয়েছে যেগুলো অশ্বেতাঙ্গ পরিবেশে বড় হওয়া যে কারো চোখে ধরা পড়বে।
উপনিবেশবাদের এই ধারা ভেঙ্গে ফেলাটা আরও বেশি কঠিন হয়ে যায় কিছু মানুষের জন্য যারা মূলত ভেতরে ভেতরে বর্ণবাদ লালন করে। তাদের সামনে যখন এই বিষয়গুলো তোলা হয় তারা খুব মনোক্ষুন্ন হয়। তারা এমনও বলে যে এইসব নিয়ে তাদেরকে শেখানোর কিছু নেই। এবং এটাই হচ্ছে গিয়ে সমস্যা, যখন উপনিবেশবাদের সুবিধাভোগীরা ঠিক করে দেয় যে কখন বর্ণবাদ নিয়ে কথা বলা যাবে আর কখন বলা যাবে না, তখন এটি আরও কঠিন হয়ে যায়। সম্প্রতি আমার এমন অভিজ্ঞতা হয়েছে যেটা এখানে বলা যায়। এক কোম্পানির মালিককে বলতে হয়েছে যে তিনি যে শব্দটা ব্যবহার করেন সেটা উপনিবেশ আমলে ব্যবহৃত একটা অপমানসূচক শব্দ। এর উদ্দেশ্য এই ছিল না যে তাকে বর্ণবাদ নিয়ে দৌড়ের ওপর রাখা বরং যারা জানে না তাদেরকে সচেতন করা। কিন্তু সেই কথোপকথনের ফলাফল দাঁড়ালো এই যে আমরা এটি নিয়ে তেমন কিছু বলতে পারলাম না, বরং আমাদেরকে কয়েকবার শুনতে হলো, ”আপনি কি কালোদেরকে অপছন্দ করেন?” এই দায় ওই ব্যক্তির নয় যে অবচেতনভাবে বর্ণবাদের চর্চা করে যাচ্ছে বরং জার্মান সংস্কৃতি, যেটা এখনো অতীতের মধ্যে পড়ে আছে।
বিভিন্ন রাস্তা, সৌধ কিংবা জায়গার নাম রাখার বেলাতে একটা ঐতিহাসিক কারণ থাকা প্রয়োজন। যখন কোন রাস্তার নাম জার্মান উপনিবেশ আমলের কোন ব্যক্তির কিংবা জায়গার নামে রাখা হবে তখন সেখানে কমপক্ষে কিছু তথ্যাবলি ঝুলিয়ে দেওয়া প্রয়োজন যাতে মানুষ জানতে পারে। এবং আমার মতে যেসব রাস্তার নাম উপনিবেশ আমলের অত্যাচারী শাসকদের নামে রাখা হয়েছে সেগুলো বদলে ফেলতে হবে।
এটা ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে, তবে খুব ধীরে এবং অনীহার সঙ্গে। কারণ উপনিবেশবাদ এখনও এদেশে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গী থেকে দেখা হয় না। যতদিন জার্মানির উপনিবেশকে ন্যায্য হিসেবে কিংবা মহান হিসেবে দেখানো হবে ততদিন পর্যন্ত এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই যে এদেশের কিছু মানুষ এই নাম বদলের বিরুদ্ধে মুখ খুলবে। গত বছরের মে মাসে এক শ্বেতাঙ্গ পুলিশের হাতে জর্জ ফ্লয়েডের নির্মম মৃত্যুর পর বিশ্বজুড়ে নানা রাস্তা, সৌধের নাম বদলে ফেলা হচ্ছে। উপনিবেশ আমলের ঐতিহাসিক ঘটনাগুলো আবারও সামনে চলে আসছে। এতে নতুন এক সম্ভাবনার দুয়ার খুলে গেছে। আশা করা যায় এই সম্ভাবনার দুয়ার গোটা জার্মানিতে আরও খুলতে থাকবে এবং এই বিষয়ে আরও আলাপ আলোচনা শুরু হবে।
যদি সত্যিকার অর্থে ইচ্ছা থাকতো তাহলে আমরা অন্তত সামাজিক পর্যায়ে এই উপনিবেশবাদের আছর থেকে মুক্ত হতে পারতাম। এই ক্ষেত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে। আর সেটার জন্য জার্মানিকে নতুন নীতি গ্রহণ করতে হবে যেটা শুরু হবে একেবারে কিন্ডারগার্টেন থেকে। একমুখী ইতিহাস আর সংস্কৃতির গণ্ডি থেকে বের হয়ে আসতে হবে।
এটা জার্মানির করতে হবে শুধু নৈতিকতার কারণে নয় বরং নিজস্ব স্বার্থেই। যারা জার্মানির পরিবর্তনশীল জনগোষ্ঠীর দিকে চোখ বন্ধ করে কেবল অতীতের সুবিধাভোগী কিছু মানুষের কথাই ভাবতে চায় তারা আসলে আমাদের দেশের ভবিষ্যতকে বিপদে ফেলতে চায়। উপনিবেশবাদের আছর থেকে গোটা বিশ্বকে মুক্ত করতে হলে আগে নিজের দেশকে করতে হবে। কারণ আমরা যে বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছি তা কোন দেশের সীমানা মানে না।