আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু
সেদিন সন্ধ্যার পর হঠাৎ করেই আনোয়ারা আপার সাথে দেখা। বয়স হয়েছে তার। চৌত্রিশের সাথে চৌত্রিশ যোগ করলে আটষট্টি বছর। বাংলাদেশের বিচারে বেশ বয়স। আমার মা আটষট্টি বছর বয়সে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। আপার সাথে শেষ দেখা হয়েছিল ১৯৮৪ সালে। কাছে এগিয়ে ডাকলাম, “আপা, চিনতে পেরেছেন?” ভুরু কুঁচকে আমাকে দেখলেন, চিনতে পেরেছেন বলে মনে হলো না। বললেন, “চেনা চেনা লাগছে, আপনার নামটা বলেন তো!” এতোগুলো বছর কেটে গেছে। চিনতে না পারলে দোষ দেয়া যায় না। তবু বললাম, “কষ্ট করে চেনার প্রয়োজন নেই, আমি যাচ্ছি।” আপা গরজ দেখালেন, “না না, যাবেন না। আপনি অনেক পরিচিত, নামটা বলে ধরিয়ে দিন।” বললাম, “আপা, আমার নাম মঞ্জু, চৌত্রিশ বছর আগে বার্লিনে তিন মাস এক সাথে ছিলাম।” মনে পড়ল তার।
চৌত্রিশ বছর আগে ১৯৮৩ সালের জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আমরা বার্লিনে কাটিয়েছি। সাংবাদিকতার ওপর একটি ডিপ্লোমা করতে জার্মান সরকারের আর্থিক সহায়তায় পরিচালিত ‘ইন্টারন্যাশনাল ইন্সটিটিউট ফর জার্নালিজম’ এ বাংলাদেশ থেকে আমরা দু’জন অংশগ্রহণ করেছিলাম। আমার প্রথম বিদেশ যাত্রা। তাও এতো দূরের এক দেশে! এক ধরণের উৎকন্ঠা কাজ করেছে। আনোয়ারা আপা বাংলাদেশ টাইমসের সিনিয়র সাব-এডিটর, আমি দৈনিক সংগ্রামের সিনিয়র রিপোর্টার। বয়সে আমার চেয়ে বছর পাঁচেক বড় তিনি। তাকে চিনতাম, কিন্তু প্রথম কথা হলো জার্মান অ্যামবেসিতে ভিসা নিতে গিয়ে। ঢাকা থেকে কলকাতা-দিল্লি হয়ে বার্লিন টেগেল এয়ারপোর্টে পৌছলে আমাদের রিসিভ করেন ইন্সটিটিউটের তখনকার কোর্স ডাইরেক্টর পিটার প্রুফার্ট। আমাদেরকে ক্রয়জবার্গে ‘কলপিং হাউজ’ নামে একটি হোষ্টেলে পৌছে দেন। বিকেলে আমাদের নিয়ে যাবেন প্রোগ্রামের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনী ডিনারে। অংশগ্রহণকারী ১৩ জন। বিকেলে আমাদের নিয়ে প্রায় বার্লিন প্রাচীর ঘেঁষে গড়ে উঠা সুউচ্চ এক ভবনে। বার্লিনের প্রভাবশালী দৈনিক ‘বার্লিনার সাইটুং’ অফিস। প্রকাশনা সংস্থা ‘বার্লিনার ফেরলাগ’ এই ভবন থেকে আরো কয়েকটি ট্যাবলয়েড ও ম্যাগাজিন প্রকাশ করে।
উদ্বোধন বলতে তেমন কিছু নয়। সবার সঙ্গে পরিচিত হওয়া ও ডিনারে অংশ নেয়া। কোর্সে ১৩ অংশগ্রহণকারীর মধ্যে আনোয়ারা আপা এবং আমি ছাড়া অবশিষ্ট ১১ জনই বিভিন্ন আফ্রিকান দেশের। পরিচয় হলো ‘ইন্টারন্যাশনাল ইন্সটিটিউট ফর জার্নালিজম’ এর ডাইরেক্টর রবার্ট এল লকনার এর সাথে। বয়সে ভাটার টান, একটু ঝুঁকে থাকেন। মৃদুভাষী, মুখে হাসি সবসময় লেগেই থাকে। অংশগ্রহণকারী প্রত্যেকের কাছে গিয়ে ব্যক্তিগত খোঁজখবর নিচ্ছেন। আরো কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তি উপস্থিত ছিলেন ডিনারে। আমাদেরকে তিন মাসে কোর্সের আউটলাইন ধরিয়ে দেয়া হলো। পরদিন সকাল থেকেই ক্লাস। এরপর আমাদেরকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখানো।
পরবর্তী তিনটি মাস ক্লাসের ফাঁকে সুযোগ পেলেই ডাইরেক্টর রবার্ট লকনারের সাথে কথা বলেছি। যতো কথা বলেছি ততো বিস্মিত হয়েছি। বর্ণাঢ্য ব্যক্তিত্বের অধিকারী। তিনি নিউইয়র্কে জন্মগ্রহণ করলেও বড় হয়েছেন বার্লিনে। তার পিতা ১৯২৪ থেকে ১৯৪১ সাল পর্যন্ত এসোসিয়েটেড প্রেস এর বার্লিন ব্যুরো চিফ ছিলেন। রবার্ট লকনার শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও অর্থনীতিতে মাষ্টার্স করার পর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে এনবিসির সাথে যুক্ত ছিলেন এবং আমেরিকান সেনাবাহিনীর সদস্য হিসেবে বার্লিনে ফিরে যান ১৯৪৫ সালে। ১৯৬৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি পশ্চিম বার্লিন সফরে গেলে লকনার তার দোভাষী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং ২৬ জুন সিটি হলের সামনে বক্তৃতা দেয়ার আগে লকনারের কাছে জানতে চান, ডয়েচ বা জার্মান ভাষায় কিভাবে “আমি একজন বার্লিনার” বলতে হবে। লকনার তাকে একটি কাগজে লিখে দেন এবং শ্রোতাদের বিপুল করতালি ও উচ্ছাসের কেনেডি তার ঐতিহাসিক বক্তৃতা শেষ করেন “ইশ বিন আইন বার্লিনার” বলে।
রবার্ট এইচ লকনারের সমৃদ্ধ ট্র্যাক রেকর্ডের কারণেই প্রেসিডেন্ট কেনেডির বার্লিন সফরকালে তাকে প্রেসিডেন্টের দোভাষির দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। তিনি ১৯৪৫ সালে বার্লিনে ফিরে গিয়ে সেখানে আমেরিকান জোনের রেডিও পরিচালক হন এবং পাশাপাশি বার্লিনের সামরিক গভর্নর লুকাস ডি ক্লে এবং হাই কমিশনার জন ম্যাক্লয়ের দোভাষি ও অনুবাদকের দায়িত্বও পালন করেন। ফ্রাংকফুর্ট থেকে প্রকাশিত ‘নয়ে সাইটুং” এর সম্পাদক ছিলেন ১৯৪৯ থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত। ১৯৫৫-৫৭ সালে সায়গনে আমেরিকান দূতাবাসে তথ্য বিভাগের প্রধান ছিলেন। ১৯৫৮-৬১ মেয়াদে ভয়েস অফ আমেরিকার ইউরোপীয় বিভাগের প্রধান, ১৯৭১-৯৬ পর্যন্ত বার্লিনে ইন্টারন্যাশনাল ইন্সটিউিট ফর র্জানালিজম এর ডাইরেক্টর ছিলেন। এছাড়া তিনি ১৯৫৪ সালে প্রেসিডেন্ট হার্বার্ট হুভারের জার্মানি সফর, ১৯৬১ সালে ভাইস প্রেসিডেন্ট লিন্ডন বি জনসনের জার্মানি সফরের সময় তাদের দোভাষি হিসেবেও কাজ করেন। তিনি বার্লিনকে এতো ভালোবাসতেন যে কখনো তার জন্মভূমি আমেরিকায় ফিরে আসার কথা ভাবেন নি। ২০০৩ সালের সেপ্টেম্বরে তিনি মারা যান।
মার দেখা বার্লিন প্রাচীর আর নেই। আমরা চেক পয়েন্ট চার্লি হয়ে পূর্ব বার্লিনে গেছি, এখন হয়তো জায়গাটির নাম একই আছে, কিন্তু তল্লাশি নেই। আমার আর বার্লিনে ফিরে যাওয়া হয়নি। চৌত্রিশ বছর আগের বার্লিন যে নেই তা বুঝতে পারি ছবি, ভিডিও দেখে। যখনই বার্লিনের কোন ঘটনা বা খবর শুনি, সবার আগে মনে পড়ে রবার্ট লকনারকে। তার পরকালীন জীবনের শান্তি কামনা করি।