Categories
গল্প

কিটি

হোসাইন আব্দুল হাই

ইউরোপের গ্রীষ্ম। টেমস নদীর টলটলে জলে খেলছে ইষদুষ্ণ ঝলমলে রোদ। বেলা গড়িয়েছে বেশ। দুপুর পেরিয়ে বিকেল ছুঁই ছুঁই। লন্ডনের উপকণ্ঠে ঝকঝকে পরিষ্কার পথের ধারেই সবুজ ঘাসের গালিচা পেরিয়ে ছিমছাম ছায়া ঘেরা দ্বিতল বাড়ি।

ইউরোপের অভিজাত এলাকায় এরকম দুই তলা এমনকি তিনতলা বাড়িগুলো অবশ্য একাধিক পরিবারকে ভাড়া দেওয়ার উদ্দেশ্যে করা হয় না। বরং একটি পরিবারের সদস্যদের জন্যেই পরিকল্পনা করা হয়। যাতে করে পরিবারের সকল সদস্য দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় তলায় ঘুমাতে পারেন। আর নিচের তলা সাধারণত কমিউনিটি সেন্টারের চাহিদা মেটানোর জন্য – মানে রান্না, খাওয়া, আড্ডা, টিভি দেখা, গান শোনা, বইপত্র পড়া, হোম অফিস এসব কাজের জন্য রাখা হয়।

ব্রিটিশ সরকারের নৌ-পরিবহণ এর বেশ কিছু শাখায় বেশ সুনাম রয়েছে বাংলাদেশের চৌকস সমুদ্র প্রকৌশলী এবং ক্যাপ্টেনদের। সেই সুবাদে বাংলাদেশের মেধাবী, দক্ষ ও পরিশ্রমী যে ক’জন প্রকৌশলী ও কর্মকর্তা যুক্তরাজ্যে কর্মরত তাদেরই একজন সিনিয়র কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন তালহা। তিনিই দুই মেয়ে এবং প্রিয় সহধর্মিনী নিয়ে এই বাড়িটিতে বসবাস করছেন প্রায় সাত বছর যাবত।

বিদেশের বুকে পরিবার নিয়ে থাকলে মাঝে মাঝেই জুনিয়র ক্যাডেটদের দাওয়াত খাওয়ার আবদার বেশ উপভোগ করতে হয়। বিশেষ করে যারা এখনও বিয়ে-থা করেনি অথবা বউ-বাচ্চা হয়তো অন্য শহরে আছে, কিন্তু পেশাগত কাজে লন্ডনে যাদের আসতে হয় মাঝেমাঝে, তাদের আবদার শুনে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন মিসেস তালহা। সেরকমই দুই জুনিয়র ক্যাপ্টেন গেরুয়া রঙের রোড রয়েলস নিয়ে এসে দাঁড়ালেন বাড়ির সামনে। কিন্তু দুজনের কাছেই খুব অবাক ঠেকে যে, এই সুন্দর গ্রীষ্মেও বাড়ির সবগুলো দরজা জানালা একেবারে যত্ন করে বন্ধ করে রাখা।

কিছুটা শঙ্কা নিয়েই দরোজার পাশে সোনালী বর্ণের কলিং বেল এ চাপ দেন ক্যাপ্টেন সমির। ঠিক দেড় মিনিটের মাথায় ক্যাপ্টেন তালহা খুব সতর্কতার সাথে আস্তে করে দরজা খুলে পা গলিয়ে নিজেকে বাইরে এনে বাইরে থেকে আবার দরজাটি ভেজিয়ে দেন। এতে খুব আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করেন ক্যাপ্টেন রাজিনঃ স্যার, কোন সমস্যা?

ক্যাপ্টেন তালহা এক ধাপ এগিয়ে এসে বলেনঃ আর বল না রাজিন, এই মাত্র কিছুক্ষণ আগেই আমার বাড়িতে কান্নাকাটি হৈচৈ পড়ে গিয়েছিল।

রাজিন এবং সমির উৎকণ্ঠা নিয়ে একসাথে জিজ্ঞেস করেঃ কেন স্যার, কী হয়েছে?

দীর্ঘ পথ পরিক্রমা পাড়ি দিয়ে নানা কাণ্ডকারখানা করে আমাদের বাসায় এক নতুন অতিথি এসে পৌঁছেছেন কাল। আর আজ তোমাদের ভাবীর ইলিশ ভাজার তীব্র গন্ধ বের করতে আমরা যেই দরজা-জানালা খুলেছি, তেমনি সেই অতিথি লাপাত্তা। আমরা সব ঘর বারান্দায় তাকে খুঁজে না পেয়ে বাড়ির বাইরে এদিক ওদিক খোঁজাখুঁজি করতে থাকি। আর এই অচেনা অজানা বিদেশ-বিভুইয়ে তার হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় আমার মেয়ে তো রীতিমত কান্নাকাটি শুরু করেছিল। আমি বাইরে এদিক ওদিক খুঁজছি, আর তোমার ভাবী এবং মেয়ে গোটা বাড়ি তন্ন তন্ন করে খুঁজছে। প্রায় ২০ মিনিট পর শেষ পর্যন্ত তাকে খুঁজে পাওয়া গেল আমার হোম অফিসে রাখা যে নতুন প্রিন্টার, সেটার কার্টুনের ভেতর। আমরা সবাই এতক্ষণ ধরে খোঁজাখুঁজি করছি আর সে বেচারা ভয়ে গুটিসুটি মেরে চুপ করে কার্টুনের মধ্যে বসে আছে।

আরে এই দেখ, তোমাদেরকে বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখেই এতসব কাহিনী বলে যাচ্ছি। এসো, তোমরা ভেতরে এসো। তবে একটু সাবধানে, কারণ আমরা যেই ভয় পেয়েছি, এখন সারাক্ষণ মনে হচ্ছে দরজা কিংবা জানালা একটু ফাঁকা পেলেই হয়তো বেচারা অতিথি কোন ফাঁকে বাইরে গিয়ে হারিয়ে যাবে।

ক্যাপ্টেন রাজিনঃ তবে যাক স্যার, শেষ পর্যন্ত যে তাকে খুঁজে পেয়েছেন, সেটাই অনেক বড় ব্যাপার। তা নাহলে তো এতক্ষণ কী অবস্থা হতো কে জানে? তবে স্যার, সেই বিশেষ অতিথিটাকেই তো আগে দেখতে হয়। শুনলাম, প্রায় মাস খানিক নাকি সময় লেগেছে, বাংলাদেশ থেকে বিমানের বিশেষ কেবিনে করে তাকে লন্ডন আনতে?

ঠিকই শুনেছ, রাজিন। আমার বড় মেয়ের খুব আদরের পাত্র সে। আমি তাকে বললাম, তোকে এখানে আরেকটা ব্যবস্থা করে দেব। কিন্তু না, আমার বড় মেয়ে সেই যে, ছোট্ট থেকে ওকে হাতে-পিঠে করে বড় করেছে – তার প্রতি যে ওর কী মায়া কেমন করে বোঝাই? ওকে ছাড়া সে লন্ডন আসবেই না। গত একমাস ধরে সে ট্রাভেল এজেন্সি খুঁজে বের করেছে, ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ এর এই দপ্তর সেই দপ্তর ঘুরে ঘুরে সে যে কত টাকা দিয়ে ওর জন্য আরামদায়ক বিলাসবহুল কেবিন বুক করেছে সে আমাকেও সেটা জানতে দেইনি। তবে ওর মায়ের কাছে যতটুকু শুনলাম বাংলাদেশি টাকাই প্রায় দুই লাখ টাকা মতো খরচ করে ফেলেছে ওর আসার পেছনে। নির্দ্ধারিত তারিখের বিমানে উড়াল দেওয়ার আগে তাকে ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ এর মনোনীত নির্ধারিত চিকিৎসকের কাছেই নিয়ে যেতে হয়েছে অন্তত পাঁচবার। টিকা দিয়েছে অন্তত এক ডজন। তার দেহের মধ্যে খুব সূক্ষ একটি চিপস বসানো হয়েছে এবং তার গত একমাসের চিকিৎসকের সকল প্রতিবেদন, চিপস এর টেকনিক্যাল তথ্যাবলী, ব্রিটিশ দূতাবাসের ছাড়পত্র মিলে সে এক বিশাল কাগজ-পত্রের স্তূপ এসেছে তার সাথে। সবমিলিয়ে প্রায় ২৫ পাতা। সেগুলোতে সবিস্তারে কয়েক ফর্দ বিবরণ রয়েছে ওকে বিমানে উড্ডয়নের আগের কয়েক সপ্তাহ কী খাওয়ানো যাবে আর কী খাওয়ানো যাবে না। রয়েছে লন্ডনে পৌঁছানোর পরের সপ্তাহগুলোতে খাবারের তালিকার সুপারিশ। বিমানের বিশেষ কামরায় আবার তার দৈর্ঘ্য-প্রস্থ-আয়তনের সাথে তাল মিলিয়ে দেয়া হয়েছে বসা, শোয়া এবং কিছুটা ঘোরাঘুরি করার জন্য প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র, খাবার, পানীয় এবং খেলনা সামগ্রী।

ক্যাপ্টেন সমির জিজ্ঞেস করেঃ এখানে হিথরো বিমান বন্দরে ওকে রিসিভ করতে কি আপনই গিয়েছিলেন, স্যার?

সে তো বটেই আর সে আরেক কাহিনী। আমার কাছে হস্তান্তরের আগে আমার পাসপোর্ট এবং এখানকার আইডি কার্ড জমা নিল দায়িত্বশীল কর্মকর্তা। আমার মেয়ে ইমেইল এ আমাকে যেসব দলিল-পত্র পাঠিয়েছিল দেশ থেকে সেগুলো জমা নিল। তারা প্রায় ১০ মিনিট ধরে সেগুলো খতিয়ে দেখার পরে, ওকে আমার সামনে নিয়ে এলো এবং তারা খুব নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করল যে, ও আমাকে চিনতে পারে কি না? ও যদি আমাকে চিনতে না পারতো কিংবা আমার কাছে আসতে না চাইতো, তাহলে এতসব দলীল-দস্তাবেজ থাকা সত্ত্বেও তারা আমার কাছে ওকে হস্তান্তর করতো না।

ক্যাপ্টেন রাজিনঃ কিন্তু আপনাকে যদি ও চিনতে না পারতো, তাহলে কী হতো, স্যার?

যদি ও আমার কাছে আসতে না চাইতো, তাহলে আমার মেয়েকে যত দ্রুত সম্ভব দেশ থেকে এসে তারপর শুধুমাত্র নিজে বিমান বন্দর থেকে বাসাই আনতে পারতো তার আদরের মিষ্টি বিড়াল ছানা কিটিকে।