Categories
প্রবন্ধ প্রবাস

হুজুগের খড়গে উপনিবেশবাদের ধারাবাহিকতা

শ্যার্ষ পালাজি

©SP

গত কয়েক বছর ধরে জার্মানির উপনিবেশবাদ নিয়ে বেশ তোড়জোড় চলছে। এর মধ্যে রয়েছেন যারা নিজেরা বর্ণবাদের শিকার হয়েছেন তারা আর তাদের সঙ্গী শ্বেতাঙ্গরা যারা অনেকদিন ধরেই জার্মানির উপনিবেশবাদের ইতিহাস এবং এই উপনিবেশবাদ প্রভাবিত ভাষা নিয়ে সরব।

বিগত ২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্রে এক শ্বেতাঙ্গ পুলিশের হাতে জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুর পর জার্মান সমাজের অনেক মানুষ নতুন করে উপনিবেশবাদ এবং এর পরবর্তী প্রভাব নিয়ে সক্রিয় হতে শুরু করেন। এর ফলাফল দাঁড়ায় যে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, স্থানীয় প্রতিষ্ঠান, সামাজিক সংগঠন এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান এই ব্যাপারে নানা সভা সেমিনার শুরু করে এবং সেখানে তারা বিশেষজ্ঞদের আমন্ত্রণ করে যেখানে তারা এই জটিল বিষয়ে আলোকপাত করেন। এমনকি অনেক সংগঠন নানা প্রকল্পও হাতে নেয়। দাতা সংস্থাগুলোও এসব প্রকল্পে আর্থিক সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেয়। এসবই প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য। উপনিবেশের সময়টাতে অনেক সম্পদ লুট করা হয়েছিল এবং বহু মানুষকে গুম করা হয়েছিলো। এসবেরে সঙ্গে জড়িত অনেক অপরাধী ব্যক্তির সম্মানে পরবর্তীতে বিভিন্ন রাস্তা-ঘাট, প্রতিষ্ঠানের নামকরণ করা হয়। সেই সম্পদ এবং মৃতদেহগুলোকে ফেরত দেওয়া এবং সেসব দাগী ব্যক্তিদের নামে নামকরণগুলো বদলে ফেলার কথা এখন উঠছে। এছাড়া প্রাত্যহিক জীবনে পদ্ধতিগত বর্ণবাদের প্রসঙ্গ নিয়েও এখন কথা বলা হয়।

আগে সঠিক বয়ান তৈরি তারপর চিন্তা

এই উপনিবেশবাদ অবসানের হুজুগের এত ডামাডোলের মধ্যে আসলে যে উপনিবেশবাদ অব্যাহত আছে তা ভুলে গেলে চলবে না। প্রশ্ন উঠতে পারে, আসলে উপনিবেশবাদের অবসান কীসে হয় আর কীসে হয় না, কোন সমালোচনাকে গ্রহণ করা যেতে পারে, কোন শব্দগুলোকে উপনিবেশবাদ আমলের বলে মনে করা হবে অথবা এই উপনিবেশবাদ অবসান প্রকল্প কতদিন ধরে চলবে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শ্বেতাঙ্গ সমাজই এসব প্রশ্নগুলো ঠিক করে দেয়। খুব কম মানুষই আছে যারা বহুদিন ধরে চলে আসা এসব ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের আধিপত্যে নাড়া দিতে চায়। মানুষ যখন এই আলোচনায় অংশ নেয় তারা এই প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করতে পারে। কারণ এইসব কাজের জন্য যে ধরণের সমর্থন দরকার হয় তা ঐতিহাসিকভাবেই কম। অনেক উপনিবেশবাদীর নামে জার্মানিতে রাস্তা ঘাট প্রতিষ্ঠানের নামকরণ করা হয়েছে, এগুলো বদলাতে গেলে বলা হয় স্রেফ ডিক্রি জারি করেই এগুলো বদলানো সম্ভব না। কারণ এগুলো জার্মানির ইতিহাসের অংশ। অনেক সময় বলা হয় যে এই দাবি গণতান্ত্রিক নয় এবং এটা নিয়ে সচেতনভাবেই কথা ছড়ানো হয়। কিন্তু রাজনীতির নামে যদি আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এই উপনিবেশবাদীদের নাম বদলাতে হয় তাহলে বলতে হবে আমাদের আস্থার জায়গায় সমস্যা রয়েছে। এটা শুধু উপনিবেশের শিকার মানুষের মুখে চড় নয় বরং যারা ডাবল স্টান্ডার্ড নিতে চান না তাদের মুখেও চড়। কারণ নাৎসি আমল আর কম্যুনিজমও আমাদের ইতিহাসের একটা অংশ। তারপরও আমরা উপযুক্ত স্মৃতিসৌধের ব্যর্থ সন্ধান করতে পারি – যাই হোক ব্যতিক্রম নিয়ম তৈরি করে দেয়।

Serge-Palasie©SP
শ্যার্ষ পালাজি ©SP

যাই হোক, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আমরা হেরেছি। নাৎসি আমলের সব কিছু আমরা ত্যাগ করেছি বিজয়ীদের নির্দেশে। কিন্তু এরপরও উপনিবেশবাদের অবসান হয়নি কারণ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিজয়ীরাও উপনিবেশবাদী ছিল। এক্ষেত্রে বিজয়ী আর বিজিত উভয়ের মানসিকতাই একরকম। সেটা সমাজকে নাৎসিদের হাত থেকে উদ্ধার এবং উপনিবেশবাদীদের স্মরণ করে রাখার ইস্যুতে। পূর্ব জার্মানির পতনের পর বিগত আমলের কমিউনিস্ট স্মৃতিসৌধগুলো রাখা যায় কিনা সে নিয়ে কথাবার্তা শুরু করতে পশ্চিম জার্মানির কোন সমস্যা হয়নি। এই ধরণের সুনির্দিষ্ট কোন আলাপ আমরা আবার উপনিবেশ আমলের স্মৃতিসৌধগুলো নিয়ে দেখি না। বরং উপনিবেশবাদীদের গ্রহণযোগ্যতা কমানোর জন্য প্রক্রিয়াগুলোর ওপর আরও জোর দিতে হচ্ছে। যদি আমি না জানি, যে রাস্তাটাতে আমি বাস করছি সেটা উপনিবেশ আমলের কোন দাগী আসামীর নামে নামকরণ করা হয়েছে, যেটা আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার কারণে খুব কমই অতীত সম্পর্কে আমাদের জানানো হয়, তাহলে সেই রাস্তা কার নামে সেটা নিয়ে আমার মাথা ব্যথা কমই থাকবে। বরং এই নামকরণ পরিবর্তনে যে সমস্য তৈরি হবে সেটা নিয়েই আমার মাথা ব্যথা বেশি হবে।

যারা উপনিবেশবাদকে ধরে রাখতে চায় তারা ইতিহাস মুছে ফেলতে চায় না। তবে ভবিষ্যতের ব্যাপারে প্রশ্ন থাকবে, আমরা রাস্তা কার নামে রাখতে চাই, একজন অপরাধীর নামে নাকি যারা রুখে দাঁড়িয়েছিল কিংবা অন্যায়ের শিকার হয়েছিল?

যদি শাব্দিকভাবেও দেখি তাহলে এই বয়ান তৈরির চেষ্টা চোখে পড়ে। যেসব শব্দ এখন পর্যন্ত স্পষ্টতই উপনিবেশিক বর্ণবাদী, যেমন নিগ্রো শব্দটা; এর পাশাপাশি আরও অনেক শব্দ বা বর্ণনা আছে যেগুলোর পেছনে মূলত একই মানসিকতা কাজ করছে, যেমন উন্নয়ন। এক্ষেত্রে উন্নয়ন বলতে শুধু অর্থনৈতিক বৃদ্ধিটাকেই দেখা হয় এবং সামাজিক এবং প্রাকৃতিক বিষয়গুলোকে পেছনে ঠেলে দেওয়া হয়। এর পেছনেও কাজ করছে সেই উপনিবেশ আমলের মানসিকতা।

পদক্ষেপ না নিয়ে শুধু আলোকপাতে লাভ নেই

Platz_an_der-Sonne
©SP

আলোকপাত করাটা ভালো তবে এতে উদ্দেশ্য সাধন হয় না। এই প্রক্রিয়ায় যে বিপদটা লুকিয়ে আছে তা হলো: এই ঢিলেঢালা অউপনিবেশবাদকরণের ফলে যারা সত্যিকারভাবে একটি পরিবর্তন চায় তাদেরকে মনে করা হয় তারা এই উপনিবেশ আমলের অবস্থা ধরে রাখতে চায় যদিও তারা সেটার বিপক্ষেই বলে থাকে। যদি এই সন্দেহ দানা বাঁধতে থাকে তাহলে আস্থার সংকট তৈরি হবে যেটা জার্মানির মতো একটি বৈচিত্রময় জনগোষ্ঠীর একতাকে বিপদের মুখে ঠেলে দিতে পারে।

যদি আমরা তা না চাই তাহলে আমাদেরকে শুধু বয়ান তৈরির এই বাহ্যিকতার বাইরে এসে সত্যিকার অর্থেই কোন একটা পদক্ষেপ নেয়ার জন্য সক্রিয় হতে হবে। এজন্য অভ্যন্তরীণ কাঠামোর দিকে নজর দিতে হবে: তার মানে একটি সংগঠন বর্ণবাদ বিরোধী সেমিনারে অংশ নিতে পারে। কিন্তু যে সংগঠন শুধু একটার পর একটা সেমিনারে অংশ নিয়েই কাজ শেষ করে কিন্তু নিজস্ব কাঠামোর দিকে নজর দেয় না তার তুলনায় যে সংগঠন এত সেমিনারে অংশ না নিয়েও নিজস্ব কাঠামো বদলের উদ্যোগ নেয় তারা অনেক এগিয়ে আছে। শুধু ঘরে বাইরে অসাম্য নিয়ে কথা বলে কিন্তু তা নিয়ে কোন কাজ না করলে কোন ফায়দা হবে না। কেবল মানুষকে দেখানোর জন্য তাড়াহুড়ো করে কিছু অশেতাঙ্গকে ঢোকালেই সবকিছু বদলে যাবে না।

যেসব নিয়ে কথা বলা হলো সেগুলো আসলে ডুবে থাকা বরফ খন্ডের দৃশ্যমান চূড়া মাত্র। এবং সেগুলো নিয়েও অনেক সময় ধোঁয়াশা তৈরি করা হয়। সামষ্টিক অর্থনীতি, পরিবেশ কিংবা নিরাপত্তার বিষয়টি আমরা এখনও সামনেই আনিনি। যদি ওই বরফ খন্ডের দৃশ্যমান চূড়ার মধ্যে আগামী কয়েক বছরে সত্যিকার অর্থেই কোন পরিবর্তন না আসে তাহলে বুঝতে হবে ডুবে থাকা বিশাল অংশটি চায় না উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে কোন অবস্থা নিতে। সমাজের অনেক মানুষ আছেন যারা আন্তরিকভাবেই উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন এবং তারা তাদের চেষ্টাকে কেবল একটি প্রকল্প হিসেবে দেখেন না। তাদের এই অবস্থানকে অস্বীকার করা উচিত হবে না। এখন পর্যন্ত যা অর্জিত হয়েছে তাকে ছোট করে দেখা যাবে না। কিন্তু এত অল্পতেও বেশি আশা করা ঠিক হবে না।