Categories
প্রবাস ব্লগ সাক্ষাতকার সাক্ষাতকার

“শরণার্থীদের মধ্যেও ভালো খারাপ আছে”

শরণার্থীরা মূলত একধরণের সস্তা শ্রম সরবরাহ করে। তবে জার্মানির সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যাবে কিছু মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। যেমন স্বাস্থ্য সেবা কিংবা শিক্ষার সুযোগের বেলাতে, যেটা বাংলাদেশে শরণার্থীরা ওইভাবে পায় না।

শরণার্থীরা মূলত একধরণের সস্তা শ্রম সরবরাহ করে। তবে জার্মানির সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যাবে কিছু মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। যেমন স্বাস্থ্য সেবা কিংবা শিক্ষার সুযোগের বেলাতে, যেটা বাংলাদেশে শরণার্থীরা ওইভাবে পায় না।

বাংলাদেশে রয়েছে বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরণার্থী শিবির, যেখানে বাস করছে মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত মুসলিম রোহিঙ্গারা। মিয়ানমারের সামরিক বা বেসামরিক কোন সরকারই তাদের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি। তাদের চরম নির‌্যাতনের মুখে লাখ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছিলো। সেই রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে সম্প্রতি ঘুরে এসেছেন বনের নির্ভরতা ও দাসত্ব শিক্ষা কেন্দ্রের গবেষক আনাস আনসার।

তিনি জানান, বাংলাদেশের দুটি জেলার রোহিঙ্গা শিবিরে বর্তমানে প্রায় ১৪ লাখ শরণার্থী বাস করছে। কক্সবাজার জেলার উখিয়া এবং টেকনাফ আর নোয়াখালীর ভাসানচর এলাকাতে সর্বমোট ৩৫টি শরণার্থী শিবির রয়েছে। এর মধ্যে সম্প্রতি ভাসানচরে বাংলাদেশ সরকার লাখ দুয়েক রোহিঙ্গাকে পুনর্বাসন করেছে। এজন্য সরকারী অর্থায়নে সেখানে নতুন অবকাঠামো তৈরি করা হয়েছে।

সীমান্ত: জার্মানিতে গত এক দশকে একই ধরণের শরণার্থী সংকট আমরা দেখেছি। প্রথমে সিরিয়া থেকে, এখন ইউক্রেন থেকে। তার সঙ্গে বাংলাদেশের শরণার্থী সংকটের পার্থক্যটা কোথায়?

আনাস আনসার: পার্থক্য হচ্ছে, ইউক্রেন কিংবা সিরিয়া কেউই জার্মানির প্রতিবেশী দেশ না। এখানে ভৌগলিক, ভাষাগত, সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয় মিল কিংবা অমিলের বিষয়টি রয়েছে। এর বাইরে জার্মানির এবং বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতা এবং বাস্তবতার মধ্যে একটা বড় পার্থক্য আছে। জার্মান সরকার অনেক আগে থেকেই বলছে, যে জার্মানির অর্থনীতিকে টিকিয়ে রাখতে হলে এই দেশে বাড়তি জনশক্তির প্রয়োজন। জার্মানিতে জনশক্তির একটা বড় ঘাটতি রয়েছে যে জন্য প্রয়োজন বিদেশ থেকে লোক আমদানির।  অন্যদিকে বাংলাদেশের জনশক্তি উদ্বৃত্ত। এই দেশ অন্য দেশগুলোতে জনশক্তি রপ্তানি করে। তাই দুই দেশের শরণার্থী সংকটের মধ্যে একটা বড় মৌলিক পার্থক্য রয়েছে।

সীমান্ত: সম্প্রতি আপনি বাংলাদেশের রোহিঙ্গা শরণার্থীদের শিবির ঘুরে দেখেছেন। আপনার এই সফরের উদ্দেশ্য কী ছিলো?

আনাস আনসার: রোহিঙ্গাদের অনেকেই এখন বাংলাদেশের জাতীয় পরিচয় পত্র নিয়েছেন, যেটা মূলত বৈধ উপায়ে নয়। তারা সাধারণত শরণার্থী শিবিরের বাইরে যেতে পারে না। এজন্য তাদের আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর অনুমতি নিতে হয়। রোহিঙ্গাদের কোন ধরণের কাজের অনুমতি নেই। কিন্তু অনানুষ্ঠানিকভাবে তাদের অনেকেই ক্যাম্পের বাইরে কাজ করে। কক্সবাজারের অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে তাদের দেখা যাচ্ছে। অনেক শরণার্থী রিকশা কিংবা ট্যাক্সি চালানোর কাজ করে। আমার গবেষণার উদ্দেশ্য ছিলো এতসব বাধার মধ্যেও তারা কীভাবে তাদের অর্থনৈতিক কার‌্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে, সেটা বের করা।

সীমান্ত: রোহিঙ্গা শরণার্থীদের অবস্থা আসলে সেখানে কেমন?

আনাস আনসার: আসলে আমরা যেভাবে রোহিঙ্গাদেরকে সীমান্তের ওপারের মানুষ হিসেবে দেখি তারা কিন্তু তাদেরকে সেভাবে দেখে না। কারণ কক্সবাজারের নাফ নদীর ওই পাড়ে তাদের বসতি যেটা এই পাড় থেকেই দেখা যায়। তাই রোহিঙ্গারা ওইভাবে নিজেদেরকে বিদেশী বলে মনে করে না। বাংলাদেশ তাদের কাছে একধরণের নিজেদের বাড়ির মতই।

অন্যদিকে ঢাকা থেকে আসা একজন সরকারী কর্মকর্তা রোহিঙ্গা শরণার্থীকে বিদেশী হিসেবে দেখলেও কক্সবাজারের একজন মানুষের কাছে তা নয়। কারণ রোহিঙ্গাদের সঙ্গে স্থানীয় বাংলাদেশীদের ভাষাগত, ধর্মীয় ও সাস্কৃতিক মিল রয়েছে। একটা রাষ্ট্র হয়তো কোন জনগোষ্ঠীর মধ্যে সীমান্ত তৈরি করে কিন্তু ওই এলাকার মানুষের কাছে এটা কেবল একটা আইনগত প্রতিবন্ধকতা মাত্র। সীমান্তের কারণে তাদের মধ্যে যে পার্থক্য তৈরি হওয়ার কথা তা কিন্তু সবসময় হয় না।

সীমান্ত: আপনি যখন সেখানে গেলেন তখন আপনার কী ধরণের অভিজ্ঞতা হয়েছে?

আনাস আনসার: আমি শুরুতে শুধু ক্যাম্পে ঘুরে বেড়িয়েছি। আমার উদ্দেশ্য ছিলা প্রথম কয়েকদিন শুধু সেখানকার অবস্থাটা পর‌্যবেক্ষণ করা। আমি দেখেছি, কারো কাছে হয়তো বিভিন্ন এনজিওর সিল মারা দশটা বালতি যেগুলো তার দরকার নেই। কিন্তু সবগুলো বালতি বিভিন্ন এনজিও থেকে পাওয়া। সেখানকার মানুষের কী প্রয়োজন সেটা না বুঝেই দাতা সংস্থাগুলো জিনিষপত্র বিলিয়ে যাচ্ছে। তাদের মধ্যে সমন্বয় নেই। ফলে সকল সংগঠনই অল্প অল্প করে খরচ করছে, কিন্তু তাতে খুব লাভ হচ্ছে না।

স্বাস্থ্য সেবার জন্য ক্যাম্পের ভেতর একাধিক ক্লিনিক রয়েছে। তার মধ্যে তুরস্কের এনজিও টার্কিশ হোপ এর ক্লিনিকটা বেশ বড়। এছাড়া বেশ কিছু প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে যেখানে বার্মিজ শেখানো হয় যেন বাচ্চারা  ভবিষ্যতে বার্মায় ফিরে কোন সমস্যায় না পড়ে। সেখানে তাদেরকে কোন বাংলা শেখানো হয় না।

বসবাসের কথা চিন্তা করলে ক্যাম্পের মধ্যেকার অবস্থা খুব করুণ। সরু গলির দুই পাশে ছোট ছোট ঘরে একেকটি পরিবার বাস করছে। পয়নিষ্কাশনের অবস্থা খুবই খারাপ।

শরণার্থী শিবিরগুলো কাটাতার দিয়ে ঘেরা। যে কোন শরণার্থী শিবিরে ঢুকতে গেলে আগে থেকে কক্সবাজারের শরণার্থী কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিতে হবে। নোয়াখালীর ভাসানচরের ক্যাম্পটি পুরোপুরি নৌবাহিনীর তত্বাবধানে। সেখানে শুধু নৌবাহিনীর জাহাজে করেই যাওয়া যায়। কোন শরণার্থী যদি বেশি অসুস্থ্য হয়ে পড়ে তখন তাকে নৌবাহিনীর হেলিকপ্টারে করে হাসপাতালে পাঠানো হয়। কোন সাংবাদিক যদি সেখানে যেতে চায় তাহলে তাকে কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে নৌবাহিনীর জাহাজে করে যেতে হবে। এসব কারণে ভাসানচরের প্রকল্পটির বিরুদ্ধে অনেক এনজিও শুরুতে আপত্তি জানিয়েছিলো। তবে তারাও এখন সেখানে কাজ করতে শুরু করেছে। সেখানকার অবকাঠামো কক্সবাজারের শিবিরের চেয়ে অনেক ভালো। ভাসানচর প্রকল্প নিয়ে বাংলাদেশী গণমাধ্যমেও তেমন কোন সমালোচনা দেখা যায়নি।

সীমান্ত: শরণার্থীদের চলাফেরার ওপর এভাবে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করাটা কী তাদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের মধ্যে পড়ে না?

আনাস আনসার: অবশ্যই। কারণ আপনার যখন ইচ্ছা তাদের ক্যাম্পে থাকতে দিবেন, যখন ইচ্ছা তাদের বের হওয়ার অনুমতি দিবেন। এভাবে তাদের চলাফেরার ওপর রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ হচ্ছে। এছাড়া শরণার্থীদের কাজ করার অনুমতি না দেওয়া, এটাও মানবাধিকারের লঙ্ঘন। তবে এরকম নিয়ম কিন্তু আমরা জার্মানিতেও দেখেছি। এখানে শরণার্থীরা তাদের জন্য নির্ধারিত হাইম বা আশ্রয়স্থলের বাইরে বেশিদিন থাকতে পারতো না। তাদেরকেও কর্তৃপক্ষের কাছে নিয়মিত হাজিরা দিতে হতো।

সীমান্ত: এই রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট নিয়ে আপনার মূল্যায়ন কী?

আনাস আনসার: শরণার্থীরা মূলত একধরণের সস্তা শ্রম সরবরাহ করে। তবে জার্মানির সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যাবে কিছু মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। যেমন স্বাস্থ্য সেবা কিংবা শিক্ষার সুযোগের বেলাতে, যেটা বাংলাদেশে শরণার্থীরা ওইভাবে পায় না। তবে সস্তা শ্রম, জোর পূর্বক কাজ করানো এইসব বিষয় আর বাকি সব দেশের মতই। অন্যসব দেশের রাষ্ট্রযন্ত্র যেভাবে নিজেদের প্রয়োজন অনুযায়ী শরণার্থীদেরকে অভ্যন্তরীণ বাজারের জন্য কাজে লাগায় বাংলাদেশেও এখন সেরকম একটি সস্তা জনবল তৈরি হয়েছে।

শরণার্থী শিবিরগুলোতে বর্তমানে হাজার খানেক এনজিও কাজ করছে যেখানে তরুণ প্রজন্মের ব্যাপক সম্পৃক্ততা রয়েছে। তবে প্রশ্ন হচ্ছে আপনি কতদিন এই ১৪-১৫ লক্ষ মানুষকে সাহায্য দিয়ে চালাবেন? ইতিমধ্যে বিশ্বে নতুন শরণার্থী সংকট তৈরি হয়েছে। যখন আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাগুলো এখানে তাদের সাহায্য গুটিয়ে নেবে তখন কী হবে? এটা নিয়ে কোন ধরণের পরিকল্পনা দেখা যাচ্ছে না। রোহিঙ্গাদের মধ্যেও বিভিন্ন উপদল তৈরি হয়েছে যারা নিজেদের মধ্যে গোষ্ঠীগত দ্বন্দ্বে লিপ্ত। তারা নিজেদের প্রভাব খাটানোর চেষ্টা করে। তাদের অনেকে অপরাধমূলক কাজ কিংবা জঙ্গিবাদেও জড়িয়ে পড়েছে। তাই শরণার্থী মানেই ভালো মানুষ, এই ধরণের ধারণা থেকে আমাদের বের হয়ে আসতে হবে। তাদের মধ্যেও ভালো খারাপ আছে।