ইউক্রেনের শিক্ষা
শ্যার্শ পালাজি
অতিথি পরায়ণতার সংস্কৃতি আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ছাড়া কেমন হতে পারে, সেটা আমরা এখন লক্ষ্য করছি।
রুশ হামলা শুরু হওয়ার পর থেকে ইউক্রেনের লাখো মানুষ বাস্তুহারা হয়ে আশ্রয়ের খোঁজে ছুটছে। তাদের অধিকাংশকেই মাতৃভূমি ছেড়ে যেতে হচ্ছে। এমনকি এসব মানুষকে ইউরোপের সীমানা পার হতেও বাধা দিচ্ছে না ইউরোপীয় ইউনিয়ন। সরকারি সংস্থাগুলো এবং জার্মানির অসংখ্য মানুষ নিজেদের সাধ্যমত চেষ্টা করে যাচ্ছে, যাতে করে বাস্তুহারা এই মানুষগুলো অতি দ্রুত সময়ের মধ্যে যতোটা সম্ভব স্বাভাবিক জীবনের স্বাদ পেতে পারে। এসব প্রচেষ্টার মধ্যে রয়েছে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ছাড়াই তাদের জন্য অবস্থান, বাড়ি-ঘর, কাজ এবং লেখাপড়ার অনুমতি প্রদান। এসব প্রচেষ্টার সবগুলো অবশ্যই আমি সমর্থন করি।
তবে এমনটি যদি সবসময় একইরকম হতো……..
কিন্তু মাত্র কয়েক মাস আগের ঘটনার দিকে যদি দৃষ্টিপাত করি – ২০২১ সালের শেষদিকে পোল্যান্ড এবং বেলারুশের মধ্যেখানে যেখানে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সীমান্ত রয়েছে – সেখানে মাইনাস তাপমাত্রায় খোলা আকাশের নিচে বেলারুশে আটকে পড়া মানুষের নিদারুণ ভোগান্তি, যারা ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে প্রবেশের জন্য সেখানে প্রতীক্ষায় ছিল – যাদেরকে লুকাশেঙ্কো তার দাবি আদায়ে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছে বলে অনেকের অভিযোগ। সেই মানুষগুলোকে পুশ ব্যাক করার যে দৃশ্য গণমাধ্যমের বরাতে দেখা গেছে – তা তৃতীয় পক্ষের মানুষগুলোর জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়নের বড়াই করা মানবিক নীতির যেন দেউলিয়াপনার শামিল। প্রায় একই সময়ে জার্মানির অধিকাংশ অঞ্চলে অনুষ্ঠিত হয় সেন্ট মার্টিন শোভাযাত্রা। আমার ছেলে-মেয়ের স্কুলের শোভাযাত্রায় আমি নিজেও আলোকবর্তিকা বহনকারী হিসেবে অংশগ্রহণ করি। মাত্র এক ঘণ্টা পরই আমি যেন ঠাণ্ডায় জমে যাচ্ছিলাম এবং সেন্ট মার্টিন এর শিক্ষা ও আদর্শ নিয়ে পরিবেশিত নাটক দেখছিলাম, যেখানে মার্টিন তাঁর নিজের ওভার কোট এর অর্ধেক অংশ এক দুস্থকে দিয়ে দেন। তাঁর এই বদান্যতার উপমা দেখতে দেখতে আমার মন চলে গিয়েছিল বেলারুশ ঘেঁষা সেই ইউরোপীয় সীমান্তে। সেখানে তীব্র শীতের মধ্যে অপেক্ষমান মানুষগুলোর জন্য ওভার কোট তো দূরের কথা, এর ছিটে-ফোঁটাও ছিল না। এই প্রেক্ষাপটে আজকের ধর্মীয় প্রথাগত সহমর্মিতার মঞ্চনাট্য আমার কাছে নিতান্তই হাস্যকর মনে হয়। একদিকে শিক্ষার্থীদের এসব পিতামাতা সেন্ট মার্টিনের নিঃস্বার্থ সহমর্মিতার ধর্মীয় প্রথা উদযাপন করছেন, অন্যদিকে তাঁরা একইসময়ে বেলারুশ ঘেঁষা ইউরোপীয় সীমান্তে আটকে পড়া মানুষগুলোর মর্মান্তিক ভোগান্তির প্রতি কোন ধরণের সহানুভূতি না দেখিয়ে পুরোপুরি অবজ্ঞা করছেন। এটা সাঙ্ঘাতিক। কারণ আমাদের ছেলেমেয়েদের প্রকৃত সহমর্মিতা শিক্ষা দেওয়া উচিত। যুদ্ধ বিদ্ধস্ত এলাকা থেকে এবং যুদ্ধ পরিস্থিতির অনুরূপ অবস্থার মধ্যে যে সূক্ষ পার্থক্য তা বিবেচনায় না আনলে – ইউক্রেন থেকে পালিয়ে আসা উদ্বাস্তু শরণার্থীদের সাথে আফগানিস্তান থেকে পালিয়ে আসা শরণার্থীদের মধ্যে পার্থক্য কোথায়? এক কথায় বললেঃ তারা (আফগানরা) সাদা চামড়ার খ্রিষ্টান নয়, এই তো? ঠিক, এটা শুনতে নিশ্চয় খুব কঠিন মনে হচ্ছে। কিন্তু ২০১৫ সাল থেকেই নয়, বরং তারও পেছনের বছরগুলোতে শরণার্থী ও অভিবাসীদের ব্যাপারে নীতিগত অবস্থানের ওঠানামা পর্যবেক্ষণ করলে এছাড়া ভিন্ন কোন উপসংহার টানার উপায় নেই। এমনকি অনেকে আপেক্ষিকতার ধারা টেনে ছদ্ম-বুদ্ধিজীবী মার্কা “ঠিক, তবে ……” ধরণের প্রতিক্রিয়া তুলে ধরেন তাতেও পরিস্থিতি পাল্টে যাবে না।
এখন আবারও আমরা পক্ষপাতমূলক সহমর্মিতা লক্ষ্য করছি ……
এমনকি আমরা যদি কোন সহমর্মিতাকেই খাটো করে না দেখি, তাহলে বলতে হয় যে, ২০১৫ – ২০১৬ সালেও কমবেশী অতিথি পরায়ণতার উপমা দেখেছি। কিন্তু ইউক্রেনের যুদ্ধের কারণে যখন সাদা চামড়ার না হয়ে বরং কালো মানুষদেরকে আশ্রয়ের খোঁজে পালাতে হচ্ছে – তখন সীমান্ত পেরনো তাদের পক্ষেও ততোটা সহজ হচ্ছে না। আমাদের সীমান্ত প্রহরীরা তাদেরকে প্রায়ই পথিমধ্যে থামিয়ে দিচ্ছে। আর তাদেরকে যদি সীমান্ত পেরনোর সুযোগ দেওয়া হচ্ছে – তবে শুধুমাত্র জার্মানির মতো অভিবাসনের জন্য লক্ষিত দেশসমূহে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। সেখানেও তাদেরকে অবস্থানের জন্য অনুমতি পত্র থেকে শুরু করে আবাসন, কাজ এবং শিক্ষার সুযোগ পেতে আমলাতান্ত্রিক জটিলতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। অসংখ্য মানুষ যারা ইউক্রেনীয় শরণার্থীদের জরুরি প্রয়োজনে সাহায্য করছে – তাদেরকে আমি দোষ দিচ্ছি না, তাদের আগ্রহ-উদ্দীপনা অবশ্যই প্রশংসনীয়, কিন্তু বর্ণ-বৈষম্যের শিকার মানুষদের প্রসঙ্গে আমাকে খুবই পরিষ্কারভাবে বলতে হচ্ছেঃ মানুষের গায়ের রঙ এর কারণে যদি সহমর্মিতায় ভেদাভেদ হয় – তাহলে আমাদের অবশ্যই কোথাও গলদ রয়েছে। এটা অবশ্য অধিকাংশ মানুষের কাছেই অজানা যে, “বর্ণবৈষম্যের কারাগারে” আমাদের যে কারাবাস – সেটার জন্য দায়ী আমাদের সহমর্মিতায় শ্রেণীভেদে তারতম্য করণ। এটা অবশ্য পরিষ্কার যে, গণমাধ্যম, রাজনীতি এবং সমাজের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া পরিভাষাই এর জন্য কমবেশী দায়ী – যেগুলো চিন্তাহীনভাবে বাঁধাধরা ছকের মধ্যে ফেলে দেয় – যা ঔপনিবেশিক সময় থেকে চলে আসা গায়ের রঙ এর উপর ভিত্তি করে নির্ণিত ভেদাভেদ এর ধারাই বহাল থাকে। এমন সংকীর্ণ এবং বিশেষভাবে বেছে বেছে কিছু মানুষের জন্য সহমর্মিতা দেখানোর ধারাকে আমাদের অবশ্যই ‘বাছাইকৃত সহমর্মিতা’ বলতে হবে। প্রকৃত সহমর্মিতা শর্তহীনভাবে সবার জন্য সমান হতে হবে, তবে শুধুমাত্র ব্যক্তিবিশেষের প্রয়োজনীয়তার উপর ভিত্তি করে অগ্রাধিকার দেওয়া যেতে পারে। গায়ের রঙ, লিঙ্গ, ধর্মীয় পরিচয়, কিংবা এধরণের কোন কিছু বিবেচনায় সহমর্মিতায় কোন ধরণের তারতম্য হতে পারে না। এক্ষেত্রে আমাদের অবশ্যই প্রবণতা পাল্টাতে হবে। শুধুমাত্র গোষ্ঠী বিশেষের জন্য সহমর্মিতা দেখানো হলে বৈষম্যের সূত্রপাত ঘটে, যা পারস্পরিক ক্ষতির কারণ হয়। শুধুমাত্র নীতিগতভাবেই নয়, বরং সকল বিবেচনায় আমাদের সমাজে এটাকে প্রশ্রয় দেওয়ার অবকাশ নেই। কেউ বৈষম্যের যে কোন একটি ধারাকে উদাসীনভাবে প্রশ্রয় দিলেই বিভেদ ও বৈষম্যের আরও সকল রূপ ও ধরণের জন্য প্রধান ফটক সম্পূর্ণ খুলে দিল, যা আজ কিংবা কাল হোক তাদের উপরেই নেতিবাচকভাবে আছড়ে পড়বে। যতদিন পর্যন্ত আমরা বৈষম্যকে নিয়মতান্ত্রিকভাবে মোকাবেলা করতে না পারবো, যদিও ব্যক্তিগতভাবে আমাদের সাথে এরূপ কিছু ইতিমধ্যে ঘটুক কিংবা না ঘটুক, ততোদিন পর্যন্ত আন্তঃ কিংবা অন্তঃসামাজিক দ্বন্দ্ব ও সঙ্ঘাত অংকুরিত হতে থাকবে, যা বর্ণ, শ্রেণী কিংবা লিঙ্গ ভিত্তিক বৈষম্যের অস্তিত্বের ফলে আরও ব্যাপকভাবে বিস্ফোরিত হতে পারে। যদি আমরা প্রকৃতপক্ষেই সবার জন্য একই জীবনবোধের পৃথিবী গড়ে তুলতে চাই, তাহলে আমাদের অবশ্যই প্রকৃত সহমর্মিতা নিশ্চিত করতে হবে। এটার বিকল্প কোন পথ নেই। শুধুমাত্র তাহলেই আমরা ভবিষ্যতের যে কোন যুদ্ধ, মহামারী কিংবা জলবায়ু পরিবর্তনের মতো বৈশ্বিক হুমকিসমূহ টেকসই পন্থায় মোকাবেলা করতে পারবো। সৌভাগ্যবশত সংকট শুরু হওয়ার পর থেকেই বেশ কিছু উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয়েছে, যারা সচেতনভাবেই উল্লিখিত দ্বিমুখী সহমর্মিতার ধারা পরিহার করেছে। তারা বর্ণভেদের উর্ধে উঠে একদিকে ইউক্রেন থেকে সকল শরণার্থীকে নিরাপদ অবস্থানে সরিয়ে নিচ্ছে, আবার অন্যদিকে লক্ষিত দেশগুলোতেও তাদেরকে সহায়তা করছে। এমন উদ্যোগ অবশ্যই সমাজের সর্বস্তরের মানুষের সম্মান ও ভক্তি পাওয়ার দাবি রাখে।