এমনি করে এদেশেই রয়ে গেলেন আর এক বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধু প্রেমিক, ডাক্তার ইউসুফ আহমদ। তিনি ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা, একাত্তরের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় তিনি ইউরোপের দেশে দেশে ঘুরে বেড়িয়েছেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে মতামত গড়ে তুলতে এবং অর্থ সংগ্রহ করতে। ঢাকা ও চট্রগ্রামের অভিজাত এলাকায় কিনেছিলেন জায়গা, একদিন দেশে ফিরে যাবেন বলে। তার স্ত্রীও পেশায় ডাক্তার। প্রেম করে তাদের বিয়ে। স্ত্রী ছিলেন পাকিস্তানী। প্রায় প্রতি সপ্তাহে তিনি আসতেন বড়ুয়ার বাসায়। গল্প করতেন, প্রায় সময় সে গল্পে বাংলাদেশ এবং বঙ্গবন্ধু। তার স্মৃতি শক্তি ছিল অসাধারণ, যাকে বলা যায় ঈর্ষণীয়। সুনীল বড়ুয়াকে তিনি ডাকতেন ‘বড়ুয়া দা’ বলে। দুজনে ছিলেন অনেকটা সময় বয়েসী। বড়ুয়া দাকে শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস করতেন অন্ধ ভাবে। তার একটি পৃথক ব্যাঙ্ক একাউন্ট ছিল, যা দেখাশোনা করতেন বড়ুয়াদা। যেদিন বড়ুয়া দা মারা গেলেন, সেদিন দেখেছি তাকে কাঁদতে, ছোট ছেলের মত ডুকড়ে ডুকড়ে। পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর তিনি দেশে যাবার মত পরিবর্তন করে ফেললেন। সামনাসামনি দেখা হলে কিংবা ফোনে কথা হলে তিনি বলতেন, ‘যে দেশে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীর কবর আছে, সে দেশে আমি ফিরে যাবো না।’ কথায় কথায় পাকিস্তানীদের ‘শালার ব্যটা’, ‘হারামজাদারা’ বলে গালিগালাজ করতেন। এমন কী তার পাকিস্তানী স্ত্রীর সামনে। আমরা বিব্রত হতাম এই কারণে যে মহিলা হাজার হলেও পাকিস্তানী। কিন্তু সেদিকে আত্মভোলা এই অতি সহজ-সরল মানুষটির কোন ভ্রূক্ষেপ থাকতো না। রাগে সে সময় তার আক্ষরিক অর্থে গা কাঁপতো। ঢাকার জায়গাটা যদ্দুর জানি তিনি এক সময় বিক্রী করে দিয়েছিলেন। চট্রগ্রামের খুলশীতে প্রায় পাঁচ কোটি টাকার জায়গাটি আর বিক্রী করা হয়নি। বছর দুয়েক আগে তার মৃত্যুর পর তার স্ত্রী জানতে চেয়েছিলেন কী করে সেই জায়গা উদ্ধার করা যায়, কোন সাহায্য করতে পারি কিনা। পরামর্শ দিয়েছিলাম হল্যান্ডে বাংলাদেশ দূতাবাসের সাথে যোগাযোগ করতে। যদ্দুর জানি এখনো কোন গতি হয়নি এবং নিশ্চিত জানি আর হবে না। জায়গাটা যদ্দুর জেনেছি ডাক্তার ইউসুফের নিকটজনরাই আত্মসাৎ করার চেষ্টায় আছে এবং তারা এই ব্যাপারে কোন সহযোগিতা করছে না। বড়ুয়া দা এবং ডাক্তার ইউসুফ। দুজনেই ছিলেন বাংলাদেশ বলতে অন্ত:প্রাণ। দুজনেই চেয়েছিলেন দেশে ফিরে যেতে। কিন্তু তাদের একজন পরবর্তীতে নিজ থেকে দেশে ফিরে যেতে চাননি, দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে। অন্যজন শারীরিক অক্ষমতার কারণে। এতো কেবল দুটি উদাহরণ। এমন বড়ুয়া দা অনেক আছে, ছিলেন, যারা চেয়েছেন দেশে ফিরে যেতে, কিন্তু ফিরে যেতে পারেননি। হয় তাদের লাশ ফিরে গেছে, কিংবা এদেশেই তার হয়েছে শেষ আশ্রয়।
আমার ভাবনা কি? আমার ভাবনা এর বাইরে নয়। এদেশে আছি ২৯ বছর। অনেকে তো ২৯ বছর বাঁচেই না। সহপাঠি মোমিন, পুরো নাম মোমিনুল হক, চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এ এফ আর হলে যার রুমে থেকে অনার্স দেয়া, সেই মোমিন পরীক্ষা দিল ঠিকই, কিন্তু জানতে পারলোনা সে ইংরেজী সাহিত্যে অনার্সে সেকেন্ড ক্লাস পেয়েছে। রেজাল্ট বের হবার দিন কয়েক আগে ধনুস্টঙ্কারে বড্ড অসময়ে মারা গেল। যে কথা বলছিলাম, এদেশে আছি ২৯ বছর, আরো দুইশো বছর থাকলেও এই দেশ তো আমার হবে না। এই দেশ পরদেশ। হোক না সোনায় মোড়ানো। হাত বাড়ালেই সব পাই। দেশের মত সব বিষয়ে সমস্যা নেই। এখানে কসাই ডাক্তার নেই, ভেজাল খাদ্য নেই, গাড়ী পথে বেঘোরে প্রাণ হারানোর ভয় নেই, চলতে গিয়ে ছিনতাইয়ের কবলে পড়ার শংকা বা আশংকা কোনোটাই নেই। নিরাপদে ঘরে ফিরতে পারি, ছেলেমেয়ে বাইরে বেরোলে মনে কোন শংকা জাগে না। তারপরও দেশ বলে কথা। জন্মভূমি! এ সেই পুরানো দিনের কথার মত- ‘ছাগল হোক পাগল হোক, স্বামী তো বটে’ ! তাই দেশে ফিরে যাবো একদিন, কোনদিন সে জানা নেই। সে ভবিষ্যত বলে দেবে বলে দেবে, তবে এ বলবো, বড়ুয়াদার মত লাশ হয়ে দেশে ফিরে যেতে চাই না। বলি বটে, ফিরে যাবো, কিন্তু কোথায় ফিরে যাব? আমার ফেলে আসা দেশটি কি ফেলে আসা দেশের মত আছে? এত দিনের ব্যবধানে দেশের শারীকির গঠন, বাহ্যিক পরিবর্তন, পরিবর্ধন, শোভাবর্ধন হয়তো অনেক কিছুই হয়েছে, তারপরও মনে হয় দেশ হারিয়েছে অনেক কিছুই। ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণে এই স্বাধীন দেশে মানুষ হয় গৃহহারা, ভিটেছাড়া এমন কী দেশ ছাড়া। অনেকে হয় জীবন ছাড়া অর্থাৎ জীবন দিতে হয়েছে এই বিশ্বাসের কারণে। প্রাণ দিতে হয়েছে কেবল নিজের চিন্তা ভাবনাকে প্রকাশ করার কারণে। একাত্তরের পরাজিত শক্তি মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। যা কিছু সুন্দর তার অনেক কিছুই গেছে নির্বাসনে, যেমনটি গেছে সুবচন। তারপরও বড্ড অবহেলা, অযত্নে গড়ে উঠা এই দেশটির জন্যে মন আকুলি-বিকুলি করে অনুক্ষণ, মন কাঁদে দেশের জন্যে, যেমন কাঁদে শেঁকড় জলকণার জন্যে।