Categories
গল্প লেখালেখি

পাশ্চাত্যের মাঝে

মূলঃ গেরগানা ঘানবারিয়ান-বালেভা

অনুবাদঃ হোসাইন আব্দুল হাই

রাইন নদীর তীর ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে নগরী বন। আমি যখন মাত্র তৃতীয় শ্রেণীতে তখন এর নাম শুনি। তখন আমাদের শ্রেণীতে একজন নতুন ছাত্রী আসে, যার নাম আন্তোনিয়া। সেসময় পর্যন্ত তার পিতামাতা পশ্চিম জার্মানিস্থ বুলগেরিয়ান দূতাবাসে কূটনীতিক হিসেবে কাজ করেছেন। রাজধানী বন এ। ব্যাপারটা আমাকে বেশ দ্বিধাগ্রস্ত করতো, কারণ তখন আমি জার্মানির রাজধানী বলতে মাত্র বার্লিন জানতাম।   

আমিও মাত্র তিন বছর আগে পিতামাতার সাথে পটসডাম থেকে সোফিয়া ফেরত এসেছি। আন্তোনিয়ার পিতামাতার সাথে আমার পার্থক্য হলো যে, শুধুমাত্র আমার মা জার্মানিতে কাজ করতেন এবং তাঁর কাজের জায়গা ছিল আপেল জ্যুসের কারখানা। আমি এতটুকু জানতাম যে, ডিডিআর আছে এবং অপরটি খুব জঘন্য, বাজে বিআরডি। আর কিছু জানতাম না।  ওহ, না, প্রাচীর সম্পর্কেও জানতাম আমি। আর তা জেনেছিলাম, কারণ বৃহস্পতিবার করে আমরা বার্লিন এ বুলগারিয়ান ভাষা স্কুলে যেতাম এবং কোন এক জায়গায় প্রাচীর এর কাছে এসে এস-ট্রেন থেমে যেত। সেটা আর সামনে যেত না। সেখান থেকে আমি সোনায় মোড়ানো বিজয় তোরণের চূড়া দেখতে পেতাম, যা আমার কাছে অগম্য মনে হতো। যাহোক, রাইন নদীর তীর ঘেঁষা বন নগরী সম্পর্কে কখনই কিছু শুনিনি।       

আন্তোনিয়া একঘেয়ে ক্লাসের মধ্যে নিয়মিত বিজ্ঞাপনের কাগজপত্র নিয়ে আসতো, সেগুলোর মধ্যে অধিকাংশই ছিল বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের এবং বিশেষ করে অটো-কোম্পানির ক্যাটালগ। সে আমাদেরকে বলতো, বন এবং রাইন নদীর উপরে দাঁড়িয়ে থাকা সেতুগুলো কত সুন্দর এবং বিজ্ঞাপন ও ক্যাটালগের ছবিগুলো দেখাতো।     

বন তখন আমার কাছে এক স্বর্গীয় ঠিকানা মনে হতো। ঠিক চকচকে, মহামূল্যবান, অগম্য এবং আকর্ষণীয় বিজয় তোরণের মতো। আমার কাছে অপরিচিত সেই জার্মান রাজধানীর ধারণা ছিল এরকম যেন দামী চামড়ার পরিধেয়, বিলাসবহুল পর্দা, বর্ণিল গালিচা, অত্যাধুনিক রান্নাঘর, লেভিস মার্কের জিন্স, ঝকঝকে থালা-বাসন, সুবাসিত কসমেটিক্স, নিভিয়া ক্রিম এবং খুব সুঠাম, সুন্দর, হৃষ্টপুষ্ট, সৌভাগ্যবান মানুষদের স্থান।   

বার্লিনের সেই পুরনো দেয়াল

আন্তোনিয়া যেন সেই নগরীর এবং রাইন নদীর তীরের জনজীবনের এক প্রতিচ্ছবি। আমাদের গাঢ়নীল, জীর্ণ-শীর্ণ স্কুলের পোশাকের তুলনায় তার পরিপাটি, ঝলমলে, পশ্চিমা পোশাক, ছোট করে ছাঁটা ব্লন্ড চুলের বাহার তাকে ৩বি শ্রেণীর সবার থেকে পুরো আলাদা করে রাখতো।

প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সেই সময় থেকে এখন বহুবছর পেরিয়ে গেছে। এখন আন্তোনিয়া কোথায় বসবাস করতে পছন্দ করে জানি না। অথচ ঘটনাপ্রবাহ আমাকে পাশ্চাত্যের মাঝখানে সেই বন এ এনে ফেলেছে। সেই বুলগেরিয়ান দূতাবাসের সামনে একদিন দাঁড়িয়ে ভাবছিলাম, “এটা যেন একরকম কল্পনা মনে হয় যে, এখানেই আন্তোনিয়া একসময় তার পিতামাতার সাথে বসবাস করতো।

খুব আশ্চর্য হয়ে আমি দেখি, যে বিনোদনের জাহাজে করে মানুষ রাইন নদীর বুক চিরে কিভাবে এগিয়ে যায়। সম্প্রতি সাদাকালো ছবির এক প্রদর্শনীতে দেখি, ১৯৩৩ সালে রাইন নদীর পাড় দিয়ে কিভাবে নাৎসি’দের গণমিছিল হচ্ছিল। তাতে দেখা যাচ্ছে, হিটলারকে স্যালুট করাতে উদ্যত মানুষের হাত এবং পানির দৃশ্য, এছাড়া আর কিছু নয়। আর দেখা গেছে রাইন নদীর বুকে ফুলে ওঠা বন্যা, যা বন এর অধিবাসীদের জন্য টলটলে কিংবা আনন্দদায়ক ছিল না।

এছাড়া রটরডেম এর দিকে ধাবমান কয়লা বহনকারী বাণিজ্যিক জাহাজগুলো চোখে পড়ার মতো। চোখে পড়বে ক্যামেরা হাতে কার্নিভ্যাল উৎসবের গোলাপি সোমবারের মাতাল সকালে জাপানিদের ভিড়। বন কেন্দ্রীয় ট্রেন স্টেশন এবং বার্থা-ফন-সুৎনার-প্লাৎস এর কাছাকাছি কন্টিনেন্টাল হোটেল এবং অসুন্দর বাড়িগুলো চোখে পড়ার মতো। এছাড়া একদিকে খুব যত্নের সাথে বেড়ে ওঠা কুকুর আর অন্যদিকে পথের ধারে ভিক্ষুকের উৎপাত।  

আজ আমার সেই ছোটবেলার ইউটোপিয়ান নগরীর মাঝে, সেই বিজ্ঞাপন ও ক্যাটালগের ছবিগুলো, যেগুলোর দিকে একদম দৃষ্টি না দিয়ে আমার ছোট্ট মেয়েটি আবর্জনা বলে ডাস্টবিনে ছুঁড়ে ফেলে, সেগুলোর বাস্তব স্যাঁতস্যাঁতে গন্ধ শুঁকে রাইনের তীরে নিঃশ্বাস নেই এবং মাতৃভূমির খোঁজ করি।