Categories
প্রবাস সাক্ষাতকার

”পাট হবে পোশাক শিল্পের চেয়েও বড়”

চার দশক আগে বাংলাদেশ থেকে জার্মানিতে আসেন ফজলে আলী খন্দকার। উদ্দেশ্য ছিলো প্রকৌশলী নিয়ে পড়াশনা করবেন। অথচ বাংলাদেশে ভর্তি হয়েছিলেন মেডিকেল কলেজে। কিন্তু মনের মধ্যে ইচ্ছা ছিলো প্রকৌশলী হবেন। তাই পরিবারের চাপকে উপেক্ষা করেই প্রকৌশল নিয়ে পড়তে জার্মানিতে পাড়ি জমান তিনি ১৯৮১ সালে। তারপর বখুমের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষ করে প্রকৌশলী হিসেবে কাজ শুরু করেন। একসময় প্রতিষ্ঠা করেন নিজের প্রকৌশল কোম্পানী D.ing360। এই প্রতিষ্ঠানে এখন চাকরি করছেন প্রায় দেড় ডজন প্রকৌশলী যাদের বেশিরভাগ প্রবাসী বাংলাদেশী।

তবে জার্মানিতে প্রতিষ্ঠিত হলেও নিজের জন্মভূমিকে কখনো ভুলে যাননি ফজলে আলী খন্দকার। ছাত্রজীবন থেকেই পাটের প্রতি তার ছিলো বিশেষ নজর। পাটের মাধ্যমে বাংলাদেশকে কীভাবে জার্মানিতে তুলে ধরা যায় সেজন্য তিনি নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করতেন। একসময় গড়ে তুলেন Khandoker Umwelt Tech নামে একটি প্রতিষ্ঠান যা এখন ইউরোজিওটেক্স নামে জার্মানিতে নিবন্ধিত।

“বাংলাদেশের সবাই শুধু পাটের তৈরি চটের বস্তা আর হাতব্যাগ নিয়েই ব্যস্ত। কিন্তু আমার উদ্দেশ্য হচ্ছে পাটকে এখানকার শিল্পায়ন লেভেলে পরিচিত করে তোলা। পাট একটি পচনশীল আঁশ এবং এর বহুমুখী ব্যবহার সম্ভব, এই তথ্যটি জার্মানিতে সকলের কাছে পৌঁছে দেয়া। যদি সেটা সম্ভব হয় তাহলে গোটা বাংলাদেশ পাট রপ্তানি করেও এখানকার চাহিদা মেটাতে পারবে না।“ সীমান্ত ম্যাগাজিনের সঙ্গে এক সাক্ষাতে এমনটি বলেন ফজলে আলী খন্দকার।

পাট নিয়ে তার মধ্যে এমন সিরিয়াস চিন্তা আসে এক দশক আগে ড্যুইসবুর্গের একটি প্রকল্পে কাজ করতে গিয়ে। সেখানকার আগুনে পুড়ে যাওয়া রেল লাইনের একটি টানেল সংস্কারের দায়িত্বে ছিলেন ফজলে আলী খন্দকার। সেখানে তিনি প্লাস্টিকের বিকল্প হিসেবে পাটজাত পণ্যের ব্যবহার করেন। এর উপকারীতা ছিল: প্রথমত এটি ছিল পুরোপুরি পরিবেশ বান্ধব এবং দ্বিতীয়ত টেকসই। এই প্রকল্পের কাজ করতে গিয়েই পাটের বহুমুখী ব্যবহার সম্পর্কে ধারণা আরও প্রকট হয়ে ওঠে।

Fazle Ali Khandoker©DieGrenze

”জার্মানির অনেক জায়গাতে নদীর দুই পাশে বাঁধ দেওয়ার কাজে ইতিমধ্যেই পাটের চট ব্যবহার করা হয়েছে, যেটাকে বলে Hangsicherung। এর সুবিধা হচ্ছে কয়েক বছরের মধ্যে এই চটের আস্তরটি মিশে যায় এবং ইতিমধ্যে সেখান থেকে ঘাষ বের হয়ে জায়গাটাকে পোক্ত করে ফেলে। এছাড়া জার্মানিতে অটোবান বা হাইওয়ের কাজে এখন অনেক জায়গাতে চট ব্যবহার করা হচ্ছে।” জানালেন প্রকৌশলী জনাব খন্দকার।

জার্মানি সহ শীত প্রধান দেশগুলোর বাড়ি এবং ভবন তৈরি করার সময় দেয়ালগুলোতে এক ধরণের বাড়তি আচ্ছাদন দেওয়া হয়। যেটাকে বলা হয় Glaswolle। এর ফলে ঘরের ভেতর তাপমাত্রা সহনীয় পর্যায়ে থাকে। এই আচ্ছাদন তৈরি করতে কৃত্রিম উপাদান ব্যবহার করা হয়। প্রকৌশলী ফজলে আলী খন্দকারের মতে এই আচ্ছাদনেও পাটের ব্যবহার করা যায়। জার্মানিতে রিটার স্পোর্ট নামে একটি প্রতিষ্ঠান ইতিমধ্যে চটের ব্যাগ থেকে এই আচ্ছাদন তৈরি করে ব্যবহার করে দেখিয়েছে। তিনি বলেন, “আগামী ২০ বছরের মধ্যে এই দেশের বেশিরভাগ ভবন সংস্কার করতে হবে। আর জার্মানির সরকারও এই ক্ষেত্রে পরিবেশ বান্ধব উপাদান ব্যবহার করার দিকেই যাচ্ছে। তাহলে ভেবে দেখুন, শুধু ভবন সংস্কারের জন্য যে পরিমাণ পাটজাত পণ্যের দরকার হবে তার পরিমানটা কত বিশাল হবে!” এজন্য ইতিমধ্যে বাংলাদেশ এবং জার্মানির দুটি সংস্থার সঙ্গে কাজ করছে তার কোম্পানি ইউরোজিওটেক্স। জনাব খন্দকার বলেন, “পাট শিল্পকে বিদেশের মাটিতে দাঁড় করানোর এখনই হচ্ছে আসল সময়। এটা হলে হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হবে, পুরনো পাটকলগুলো আবারও চালু হয়ে উঠবে। পাট ও পাটজাত পণ্য হবে পোশাক শিল্পের চেয়েও বড়।”

তবে এই পাট নিয়ে কাজ করতে গিয়ে বাংলাদেশে কম ভোগান্তি তাকে পোহাতে হয় নি। জনাব খন্দকার বলেন, ”আমি বাংলাদেশ থেকে যখন পাটের আঁশ আনতে গেলাম তখন সরকারী অফিসে আমাকে সরাসরি জিজ্ঞেস করা হলো আপনি ভারত থেকে নিচ্ছেন না কেন? আমি বাংলাদেশে বসে কেন ভারতের পাট আনতে যাবো?” জনাব খন্দকারের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া। তিনি বলেন, “বাংলাদেশের নীতি নির্ধারণী মহলে যারা বসে আছেন তাদের অযোগ্যতা আর দুর্নীতির কারণে আমাদের দেশ এখনও তলানীতে পড়ে আছে। নইলে আমাদের দেশ আরও অনেক এগিয়ে যেতো।” এরপরও বসে থাকেননি তিনি, চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন পাটকে জার্মানিতে একটি শক্ত অবস্থানে নিয়ে আসতে। “যদি আমি এটা করে যেতে পারি তাহলে শান্তিতে মরতে পারবো” বললেন ৬৩ বছরের প্রবাসী ফজলে আলী খন্দকার।