ড. হোসাইন আব্দুল হাই
জার্মান ফেডারেল সংসদ ক্রীড়া সংঘের দাবা ক্লাবের সদস্যরা মে মাসে অনাড়ম্বর আয়োজনের মধ্য দিয়ে ৫০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন করেছে৷
প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী দিবসে বনের ফেডারেল প্রেস অফিসে একটি তড়িৎ গতির দাবা প্রতিযোগিতা (চিন্তার জন্য সময় মাত্র ৫ মিনিট) অনুষ্ঠিত হয়। প্রতিযোগিতায় নয়জন খেলোয়াড় অংশ নেন। সর্বোচ্চ সাড়ে ছয় পয়েন্ট নিয়ে চ্যাম্পিয়ন হ্ন হোলগার হাঙ্ক। প্রত্যেকে সাড়ে পাঁচ পয়েন্ট নিয়ে যৌথভাবে দ্বিতীয় অবস্থানে ছিলেন ইয়াগো স্টাইনমান এবং রাইনার স্টার্ক।
জার্মান ফেডারেল সংসদ ক্রীড়া সংঘের দাবা ক্লাব ৫০ বছর ধরে বন নগরীতে অন্যতম বৃহৎ দাবা চর্চার প্রতিষ্ঠান হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে। এর যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৯৭৩ সালের ১৫ মে, যেদিন তৎকালীন ফেডারেল সংসদের স্টেনোগ্রাফার কার্ল স্টেটনার এবং সংসদীয় প্রশাসনের দাবাপ্রেমী কিছু কর্মকর্তা দাবা খেলার জন্য বনের সুউচ্চ ভবনের ২৭০২ নম্বর সভা কক্ষে মিলিত হন। পরে ফেডারেল সংসদের কিছু সদস্য এবং অন্যান্য দাবা অনুরাগীরা এই ক্লাবে যোগ দেন।
পরবর্তীতে দাবা খেলার স্থানটি পি-০১ নম্বর সভা কক্ষে স্থানান্তরিত করা হয়, যেখানে জার্মান সংসদের প্রবীণ পরিষদ মিলিত হতো। ১৯৭৫ সালে দাবা ক্লাবের সদস্যরা দলগত লড়াইয়ে অংশ নেওয়ার সাহস করেন এবং শীঘ্রই ক্লাবের জন্য ব্যাপক সাফল্য ও সুনাম বয়ে আনেন। এমনকি এই দাবা ক্লাব ১৯৮০ সালে মহানগরী ও জেলা লীগে শক্ত অবস্থান করে নেয়।
পর্যায়ক্রমে ক্লাবের পরিধি ও কার্যক্রম বাড়তে থাকে। ক্লাবের অভ্যন্তরীণ টুর্নামেন্টগুলি ছাড়াও, বার্ষিক তড়িৎ গতির দাবা প্রতিযোগিতার মতো বড় আয়োজন হতে থাকে। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল বিশ্ববিখ্যাত দাবা মহারথীদের এই ক্লাবের নানা আয়োজনে অংশগ্রহণ। দাবা গ্র্যান্ডমাস্টার লুডেক পাখমান, ভোলফগাঙ উনসিকার, ডঃ হেলমুট ফ্লেগার এমনকি সাবেক বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ডঃ মিশায়েল বোটভিনিক এবং নারী বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন জুজা পোলগার তৎকালীন সংসদীয় ক্রীড়া সংঘের দাবা ক্লাবে পদধূলি দিয়েছিলেন। ২০০৮ সালে বনে অনুষ্ঠিত বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপের লড়াই উপলক্ষে তড়িৎ গতির দাবা প্রতিযোগিতাও আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে বেশ গুরুত্বপূর্ণ স্থান করে নিয়েছিল।
এই ঐতিহ্যবাহী দাবা ক্লাবের দীর্ঘতম সদস্যদের মধ্যে একজন হলেন হারমান বোয়ে, যিনি দাবা গ্রুপটি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকেই খেলে আসছেন। তাঁর ভাষায়, “সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় ছিল দাবার মহারথীদের সাথে বড় বড় ইভেন্টের আয়োজন।” সাবেক গ্রুপ লিডার জিগফ্রিড কখ, যিনি এখনও দাবার জগতে সক্রিয় রয়েছেন, এই বিশাল আয়োজনগুলো করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী টুর্নামেন্টের বিজয়ী হোলগার হাঙ্ক ২০১২ সাল থেকে এই দাবা ক্লাবের সদস্য। ডয়চে ভেলে একাডেমির বিভাগীয় প্রধান হিসেবে কর্মরত হাঙ্ক বলেন, “আমি বিশ্বাস করি যে, এখানে বন মহানগরীতে, বিশেষ করে মন্ত্রণালয়, সরকারি দপ্তর এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোতে যারা কর্মরত রয়েছেন তাদের মধ্যে, অনেক দাবা খেলোয়াড় আছে। যদি আমরা একটি আকর্ষণীয়, বিনোদনমূলক পরিবেশ তৈরি করতে পারি, তাহলে এই দাবা ক্লাবটি আরও ৫০ বছর মাথা উঁচু করে এগিয়ে যেতে পারবে।‘‘ তবে সামগ্রিকভাবে, যে দাবা ক্লাবগুলিতে যুবকদের আকর্ষণ করার জন্য কিংবা তাদের জন্য প্রশিক্ষণের কোন ব্যবস্থা না করে, বরং শুধুমাত্র প্রাপ্তবয়স্ক খেলোয়াড়দের দিকেই লক্ষ্য রাখে, তাদেরকে নতুন সদস্য অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে বেশ অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়। হ্যাঙ্ক এর মতে, “এটি শুধুমাত্র ফেডারেল সংসদ ক্রীড়া সংঘের দাবা গ্রুপের জন্যই নয়, বরং সব দাবা ক্লাবের জন্যই একটি জটিলতা।”
ফ্রান্স-হেলমুট মুলারের পোস্টব্যাংক এর প্রাতিষ্ঠানিক দাবা ক্লাবের হয়ে খেলার অনেক বছরের অভিজ্ঞতা রয়েছে। এরপর তিনি জার্মান ফেডারেল সংসদ ক্রীড়া সংঘের হয়ে প্রায় দশ বছর ধরে খেলেছেন। তিনি প্রাতিষ্ঠানিক দাবা চর্চার সুসময়ের স্মৃতি হাতড়ে বলেন, “একসময় বন নগরীতে প্রায় ৪০ টি দাবার টিম ছিল, যার বেশিরভাগই মন্ত্রণালয়গুলোকে প্রতিনিধিত্ব করতো, যার মধ্যে বেশ কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের এমনকি তিনটি করেও দল ছিল। বনের প্রায় সকল শিল্প প্রতিষ্ঠানের দাবা গ্রুপ ছিল, যেমন বাড গোডেসবার্গ, মেহলেম এবং জাংক্ট অগাস্টিনে। সেসময় জেনারেল ইলেকট্রিক এর দলও বেশ ভালো অবস্থানে ছিল। দুর্ভাগ্যবশত, কিছু দাবা খেলোয়াড় অন্য কোন নগরীতে কিংবা অঞ্চলে চলে গেছেন, আবার কিছু খেলোয়াড় মারা গেছেন।
প্রায় তিন দশক আগের কথা, মার্টিন স্টামার তখন একজন ফেডারেল সাংসদের সহকারী ছিলেন এবং জার্মান সংসদীয় ক্রীড়া সংঘে দাবা খেলা শুরু করেছিলেন। এই দাবা ক্লাবের বিশেষত্ব সম্পর্কে তিনি বলেন, জার্মান ফেডারেল তথ্য অধিদপ্তরের এই সুরক্ষিত প্রাসাদে আমাদের এই ক্লাবের দাবা খেলা এবং অনুশীলন অনুষ্ঠিত হয় বলে সাধারণ মানুষের প্রবেশাধিকার খুব সীমিত। এছাড়া এই ক্লাবের অধিকাংশ সদস্যই নিজেদের মধ্যে আপনি বলে সম্বোধন করেন, যেটা জার্মানির কর্মস্থল, ক্রীড়া সংঘ কিংবা সাংস্কৃতিক অঙ্গনে খুব বিরল।
এই দাবা ক্লাবের বর্তমান প্রধান রাইনার স্টার্ক ক্লাবের ৫০ বছর পূর্তি সম্পর্কে বলেন, “আমি মনে করি এটি এমন কিছু যা নিয়ে আমরা বেশ গর্ব করতে পারি। ৫০ বছর ধরে এই এখনও শক্তিশালী অবস্থানে আছে, এটা গর্বের বিষয়, তবে আমাদের এখন ভবিষ্যতের কথাও ভাবতে হবে এবং ভবিষ্যতের জন্য আমরা কীভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছি তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।”
জার্মানির রাজধানী বন থেকে বার্লিনে চলে যাওয়ার পর জার্মান ফেডারেল সংসদের বনে কোন স্থাপনা ছিল না, তাই এই ক্লাবের কার্যক্রম ফেডারেল সরকারের তথ্য অধিদপ্তরে স্থানান্তরিত করা হয়। সেই থেকে সেখানেই প্রতি সোমবার সন্ধ্যায় দাবা খেলা চলে আসছে। কুর্ট ভাগনার সেই ঘটনার কথা স্মরণ করে বলেন,“আমি তখন ফেডারেল প্রেস অফিসে কাজ করতাম। এই ক্লাবের জন্য আমরা যখন একটি নতুন স্থান খুঁজছিলাম, আমি এখানে আলাপ করি, তখন তারা একবাক্যেই হ্যাঁ বলেন। সেই থেকে আমরা এখানেই খেলছি।”
দুই বছরের করোনা বিরতির পর, ২০২২ সালের জুন থেকে আবারও ক্লাবের কার্যক্রম পুনরায় শুরু হয়েছে। ক্লাবের সদস্যরা দলীয়ভাবে এবং এককভাবে নিয়মিত বিভিন্ন টুর্নামেন্টে অংশ নেন। এখন ক্লাবের সদস্যরা দিন গুনছেন ২০৭৩ সালের ১৫ মে একশ‘ বছর উদযাপনের জন্য।