Categories
প্রবন্ধ প্রবাস

জার্মানিতে রবীন্দ্রনাথ ও তার সাহিত্য

সজল তরফদার

রবি ঠাকুর তাঁর জীবদ্দশায় তিন তিন বার জার্মানি ভ্রমণ করেছেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর যুদ্ধ বিধ্বস্ত জার্মানির ক্ষত তখনও সেরে উঠেনি। একদিকে যুদ্ধ বিধ্বস্ত কল-কারখানা, অন্যদিকে বিজ্ঞান-সাহিত্যের মেলবন্ধন। রবি ঠাকুরের প্রথম জার্মান সফর ১৯২১ সালে, দ্বিতীয় ১৯২৬ সালে এবং সর্বশেষ ১৯৩০ সালে। তাঁর নোবেল পুরষ্কার পাওয়ার আগে (১৯১৩ সালে কাব্যগ্রন্থ গীতাঞ্জলির জন্য) ইওরোপ, আমেরিকা কিংবা আরব অঞ্চলে ভারতীয় সাহিত্য নিয়ে তেমন কোন ধারণা ছিল না। শেক্সপিয়ার, দান্তে এবং তলস্তয়ের অনুবাদ সাহিত্য ততদিনে পৃথিবীর সবখানে ছড়িয়ে পড়েছে। এখন থেকে প্রায় দুইশ বছর আগে শেক্সপিয়ার সাহিত্য জার্মান ভাষায় অনুবাদ করে তা জার্মানির বিশ্ববিদালয়গুলোতে নিয়মিত পড়ানো হত। সেখানে ইওরোপীয়রা ভারতীয় সঙ্গীত, ধর্ম, সাহিত্য সম্পর্কে ছিল একেবারেই অজ্ঞাত। যে যাই বলুক ধর্ম কিংবা সংস্কৃতি দিয়ে কিন্তু ভারতবর্ষ আধুনিক ইওরোপের সাথে যোগসূত্র স্থাপন করতে পারে নাই। সেসময় রবীন্দ্রনাথ একমাত্র যিনি সাহিত্য, কবিতা, গান, দর্শন দিয়ে আধুনিক ইওরোপের সাথে ভারতবর্ষকে একই সুতায় গেঁথেছিলেন। রবিঠাকুর জার্মানি এসেছিলেন মুলত গীতাঞ্জলির অনুবাদ ও তার প্রকাশকের আমন্ত্রনে।

জার্মানি ভ্রমণের পূর্বে রবি বলেন যুদ্ধ বিদ্ধস্ত জার্মানদের কাছে সাহিত্য তেমন গুরুত্বপূর্ণ হবে না।দীর্ঘ এক মাসে রবি ঠাকুর জার্মানির বিভিন্ন শহর ঘুরে দেখেন। তার ধারণা ছিলো যুদ্ধবিদ্ধস্ত নাৎসি জার্মানরা তাকে ঠিক সেইভাবে গ্রহণ করবে না। কিন্তু এটা ছিল পরোপুরি ভূল ধারণা। রবির জার্মানির ভ্রমণের প্রতিটা কথা এদেশের পত্রিকাতে নিয়মিত স্থান পেয়েছিলো। জার্মানি ভ্রমণের অভিজ্ঞতা নিয়ে রবি তাঁর বন্ধুকে এমনভাবে লিখেছিলেন, “জার্মান ভ্রমণ আমার জীবনে একটা স্মরণীয় ঘটনা। যে সম্মান পেয়েছি তা আমার প্রাপ্য ছিল না। তাদের ভালোবাসা, আন্তরিকতায় ভীতু, ক্লান্ত ও দুঃখী ছিলাম। কারণ এই সম্মানের যোগ্য আমি নই।”

রবীন্দ্রনাথের জার্মানির ভ্রমণের সময় তাঁর সাথে অনেক প্রখ্যাত সাহিত্যিক এবং লেখকের দেখা সাক্ষাৎ হয়। অস্ট্রিয়ার থমাস মান এবং স্টেফান সোয়াইগ নামক দুই লেখক রবি ঠাকুরের সাথে ১৯২১ সালের গ্রীষ্মের একদিন দেখা করেন। রবীন্দ্রনাথের সাথে স্টেফান সোয়াইগের সাক্ষাৎপর্ব ছিলো বড়ই চমৎকার। কুট ভোল্ফ নামক এক ভদ্রলোক স্টেফান সোয়াইগকে অবহিত করেন যে রবীন্দ্রনাথ ভিয়েনা যাবার পথে জালজবুর্গে ট্রেন পরিবর্তন করছেন। স্টেফান সোয়াইগ এসময় সেখানে অন্য একটা ট্রেনে ছিলেন। তিনি তাঁর ট্রেন থেকে লাফ দিয়ে নেমে পড়েন এবং সেখান থেকে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করতে চলে যান। খুবই সংক্ষিপ্ত তবে গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষাৎকার ছিলো সেটি।

১৯০৮ কিংবা ১৯০৯ সালে এক শীতে স্টেফান সোয়াইগ ভারত ভ্রমণ করেছিলেন। তাঁর দেখায় তখন ভারত ছিলো দারিদ্র ও দুর্ভিক্ষে নিপতিত এবং স্বাধীনতা সংগ্রামে ব্যস্ত এক জনপদ কিন্তু এত কিছুর পরও রবীন্দ্রনাথ কীভাবে বিশ্বজনীন হলেন এবং ভারতীয় সাহিত্যকে বিশ্ব দরবারে পৌঁছে দিচ্ছিলেন, তাতে সোয়াইগ বেশ অবাক হন।

আরেক বিখ্যাত জার্মান লেখক ছিলেন থমাস মান। তিনি অবশ্য প্রথমে রবীন্দ্রনাথের সাথে দেখা করতে চাননি। কারণ তাঁর ধারণা ছিল, জার্মান সংবাদপত্র এই ভারতীয় সাহিত্যিককে খুব বেশি বাড়িয়ে দেখাতে শুরু করছে। হেরমান কেসেরলিং নামক এক লেখক ও দার্শনিক যখন এক পত্রিকায় বড় করে লিখলেন, “ঠাকুর সপ্তাহ” রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এক সপ্তাহের ভ্রমণ লিপি, তখন থমাস মান একটু বিরক্ত হয়েছিলেন। কারণ আরও অনেক পশ্চিমা লেখকের মত তিনিও রবীন্দ্রনাথের লেখার ব্যাপারে অবগত ছিলেন না।

এর কয়েক সপ্তাহ পর রবীন্দ্রনাথের মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা বক্তৃতা দেওয়ার কথা ছিলো। থমাস মান রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করতে ইতস্তত বোধ করছিলেন। যেহেতু থমাস মানের বাড়ি ছিলো মিউনিখ শহরে তাই তিনি ও তার স্ত্রী কাটিয়া শেষ পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথের লেকচারে অংশ নেন। মজার ব্যাপার ছিলো, থমাস মান রবীন্দ্রনাথের সাথে আলাপকালে বারবার তার স্ত্রী কাটিয়াকে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলেন। উল্লেখ্য, ১৯২৯ সালে থমাস মান সাহিত্যে নোবেল পুরষ্কার পান।

আরেক জার্মান লেখক হেরমান হেসে ছিলেন রবীন্দ্রনাথের লেখার সমালোচক। হেরমানের বাবা দক্ষিণ ভারতের এক গির্জায় মিশনারি ছিলেন। তাই তিনি থমাস মানের মত ভারতের সাহিত্যের ব্যাপারে অনভিজ্ঞ ছিলেন না। ছোটবেলা থেকেই ভারত, শ্রীলংকা এবং ইন্দোনেশিয়ার সংস্কৃতি ও জীবনাচারের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন হেরমান হেসে। রবীন্দ্রনাথ যখন জার্মানি ভ্রমণ করেন হেরমান হেসে গভীরভাবে তা পর্যবেক্ষণ করেন। রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলী, মালি এবং ঘরে বাইরে এই তিনটা উপন্যাসের রিভিউ করেছেন তিনি। হেরমান হেসের ভাষায় রবীন্দ্রনাথের লেখা অনেকটা ইওরোপীয় ধাঁচের।

রবীন্দ্রনাথের সাথে আলবার্ট আইন্সটাইনের সাক্ষাৎ হয়েছিলো, সেটি ১৯৩০ সালে। রবীন্দ্রনাথ আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিলেন সাহিত্য বিষয়ক কোন আলোচনায় তিনি যাবেন না। অপরদিকে আইন্সটাইনও ঠিক করে রেখেছিলেন তিনিও বিজ্ঞান বিষয়ক কোন প্রসঙ্গ টেনে আনবেন না। কিন্তু দুজনার সাক্ষাৎপর্বে চলে আসে “সঙ্গীত”। আইন্সটাইনের একটি প্রশ্ন ছিলো রবি ঠাকুরের কাছে, বাংলা এমন কোন সঙ্গীত আছে যেখানে গায়ক গানের কথা রেখে নিজের কথা বলতে পারে। উত্তরে রবি বলেন, আছে, তার নাম কীর্তন।

রবীন্দ্র রচনা জার্মান ভাষায় অনুবাদ করার উদ্যোগটা খুব একটা সুখকর ছিলো না। রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যের প্রকাশক কুট ওল্ফ ১৯২১ সালে জার্মানিতে প্রথম তাঁর লেখা নিয়ে আসেন। কিন্তু ১৯২৩ সালে জার্মানির প্রকাশনার বাজারে মন্দা নামার পর কুট ওল্ফ দেউলিয়া হয়ে পড়েন। এই অবস্থায় রবীন্দ্র রচনা জার্মানির বাজারে প্রচার পেতে ব্যর্থ হয়। তবে এরপরও অনেক প্রকাশক রবীন্দ্রনাথের বই বাজারে বের করার চেষ্টা করেন। এদের মধ্যে পথিকৃৎ ছিলেন হেলেন ম্যায়ার ফ্রাঙ্ক এবং তার স্বামী হেনরি ম্যায়ার। তাঁরা রবীন্দ্রনাথের বইয়ের স্বত্ব কিনে নেন। শুরুতে রবি ঠাকুরের বই ইংরেজিতে ভাষায় এবং তা থেকে জার্মান ভাষাতে অনুবাদ হতো। তাই তাতে সরাসরি বাংলার স্বাদ আসতো না। এই সমস্যা দূর করার জন্য হেনরি ম্যায়ার ফ্রাঙ্ক নিজেই বাংলাটা শিখে নিয়েছিলেন। ১৯৩০ সালে প্রথম বাংলা থেকে জার্মান ভাষায় অনুদিত বই ছাপানো হয়। কিন্তু ১৯৩৩ সালে নাৎসি বাহিনীরা হেলেন ম্যায়ার ও স্বামী হেনরি ম্যায়ারকে হত্যা করে। এরপর থেকে কার্যত রবীন্দ্র রচনার জার্মান অনুবাদের কাজটি বন্ধ হয়ে যায়। দুঃখের বিষয় হলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর রবীন্দ্রনাথের বই রুশ ভাষা থেকে জার্মান ভাষায় অনুবাদ করা হয়। কারণ কমিউনিস্ট রাশিয়ার সঙ্গে ইন্ডিয়ার কমিউনিস্টদের যোগাযোগ ছিলো ভালো। তার সূত্র ধরে রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য প্রথমে রুশ ভাষায় এবং তা থেকে জার্মান ভাষায় অনুবাদের কাজ শুরু হয়।