হোসাইন আব্দুল হাই
সেই সত্তরের দশক থেকেই ইওরোপের সবচেয়ে শক্তিশালী অর্থনীতির দেশ জার্মানিতে পাড়ি জমানো শুরু করেন বাংলাদেশীরা। প্রথমদিকে জার্মানিতে আসা বাংলাদেশীদের অধিকাংশই বর্তমানে নিজস্ব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় ব্যস্ত সময় কাটান। এছাড়াও তাদের অধিকাংশই জার্মানির বিভিন্ন নগরীতে জার্মান-বাংলাদেশ সমিতি, একাডেমি, সাংস্কৃতিক কেন্দ্র কিংবা বাংলা ভাষা স্কুল নামে নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন গড়ে তুলেছেন।
এসব সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের উদ্যোগে প্রতি বছর বাংলাদেশের বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস, বাংলা নববর্ষ তথা পহেলা বৈশাখ, পিঠা উৎসব, ঈদুল ফিতর, ঈদুল আযহা, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম ও শাহাদাত বার্ষিকী পালন করা হয়। এসব অনুষ্ঠানে সাধারণত বাংলা ভাষা, বাংলা সাল এবং বাংলাদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট নিয়ে আলোচনা ছাড়াও পরিবেশিত হয় গান, কবিতা, ছড়া, নৃত্য, কৌতুক, অভিনয় ও মজার মজার ঘরোয়া খেলাধুলা। এসব সংগঠনের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে আসা অভিবাসীদের ছেলেমেয়েরা কিছুটা হলেও পিতৃপুরুষের ভাষা, সংস্কৃতি ও ইতিহাস-ঐতিহ্য সম্পর্কে জানার ও চার্চার সুযোগ পেয়ে থাকে। এছাড়া দেশে রক্ষণশীল পরিবারে বেড়ে ওঠা অনেকেই জার্মানির উদারমান সামাজিক পরিবেশে সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক অঙ্গণে নিজেদের সুপ্ত প্রতিভা বিকাশের সুযোগ পেয়ে থাকেন।
এসব বিশেষ বিশেষ দিবস এবং উৎসবকে ঘিরে আয়োজিত অনুষ্ঠানগুলো বাংলাদেশী প্রবাসীদের জন্য এক মহা মিলনমেলায় পরিণত হয়। আয়োজন থাকে নানা পদের সুস্বাদু দেশী-বিদেশী খাবারের। প্রদর্শনী ও কেনাকাটা হয় দেশী-বিদেশী নানা আলোকচিত্র, তৈলচিত্র, জলছবি, পোশাক-আশাক, অলঙ্কার ও সৌখিন হস্তশিল্প সামগ্রী। আর ইওরোপের এই ধনী দেশে সারাক্ষণ পশ্চিমা পোশাক পরে থাকতে হলেও এই অনুষ্ঠানের দিনগুলোতে অন্তত দেশী সাজে নিজেদের সাজিয়ে তোলার সুযোগটি সাধারণত কেউ হাতছাড়া করেন না।
সবচেয়ে বেশী চোখে পড়ে মাতৃভূমি ছেড়ে প্রায় দশ হাজার কিলোমিটার দূরে বিশ্বের অন্যপ্রান্তের এই দেশে এসে নিজ দেশের নানা স্মৃতি হাতড়ে বেড়ানো বাঙ্গালী হৃদয়ের আকুলতা। সেই আকুলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটে নানা সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বের কাজের মধ্যে দেশে গৌরবময় কীর্তিগাঁথা তুলে ধরার প্রচেষ্টা। কেউ গড়ে তোলেন ছোট্ট একটি শহীদ মিনার, স্মৃতি সৌধ, জাতীয় পতাকা কিংবা প্রিয় রাজনৈতিক অথবা সামাজিক-সাংস্কৃতিক ব্যক্তিদের প্রতিকৃতি। নানা দেশী কারুকার্য করেন মঞ্চ কিংবা অনুষ্ঠানস্থলের প্রবেশ পথে। পহেলা বৈশাখে রমনা বটমূলে যেমন রঙের বাহার থাকে ঠিক একই বাহারে সাজানো হয় ইওরোপের দেশটির অনুষ্ঠানস্থলের আশপাশ। প্রায় একইরকমের দেশী কারুকার্য খচিত ঘর-বাড়ির দেখা মেলে পারিবারিক ও সামাজিক অনুষ্ঠান যেমন বিয়ে-শাদি, গায়ে হলুদ কিংবা জন্মদিন পালনকে ঘিরেও।
দীর্ঘদিন ধরে জার্মানিতে বসবাসকারী বাংলাদেশীদের অনেকেই আবার বিভিন্ন নগরীতে তৈরি করেছেন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান তথা মসজিদ কিংবা পুজা মণ্ডপ। বার্লিন, বন, ফ্রাঙ্কফুর্ট, ডর্টমুন্ড, হামবুর্গ, স্টুটগার্ট, মানহাইম, মিউনিখের মতো জার্মানির প্রায় সব বড় বড় নগরীতেই এখন দেখা মেলে বাংলাদেশী মসজিদের। এসব মসজিদে যে শুধু নামাজ পড়া হয় তা নয়, বরং মসজিদগুলো বাংলাদেশী প্রবাসীদের একেকটি মিলনস্থলে পরিণত হয়েছে। অধিকাংশ মসজিদই ধর্ম ও ভাষা শিক্ষাকেন্দ্র ও নানা সামাজিক কর্মকাণ্ডের উৎস হয়ে উঠছে। সংশ্লিষ্ট নগরিতে বসবাসরত বাংলাদেশীরা যে কোন প্রয়োজনে ছুটে যান এসব ধর্মীয় মিলনকেন্দ্রে।
বিশেষভাবে সম্প্রতি এশিয় ও ইওরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে জার্মানিত পাড়ি জমানো বাংলাদেশী শরণার্থীদের জন্য খুব বড়মাপের সহায়তা ও আশ্রয়স্থল হিসেবে ভূমিকা রাখছে মসজিদগুলো। গেল বছর যুদ্ধ বিধ্বস্ত সিরিয়ার শরণার্থীদের জন্য জার্মান সরকার সীমান্ত উন্মুক্ত করে দিলে তাদের সাথে প্রচুর সংখ্যক বাংলাদশী অভিবাসী কর্মী জার্মানিতে প্রবেশ করে। কিন্তু একসাথে এতো বেশী রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থীর জন্য আবাসন ও খাবার-দাবারের আয়োজন করতে হিমশিম খেতে থাকে স্থানীয় নগর কর্তৃপক্ষ। এমন অবস্থায় দীর্ঘ সড়ক ও সমুদ্রপথ পাড়ি দিয়ে আসা বাংলাদেশী শরণার্থীদের জন্য মাঝে মাঝেই দেশী খাবারের ব্যবস্থা করে ডর্টমুন্ডের বাংলাদেশী মসজিদ এবং বন নগরীর বাংলাদেশী মসজিদ ও শিক্ষাকেন্দ্র হাউজ ডের ইন্টেগ্রাৎসিওন।
এছাড়া বাংলাদেশ থেকে লেখাপড়া করতে জার্মানিতে আসা নতুন ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য সংবর্ধনা ও পরিচিতিমূলক অনুষ্ঠানের আয়োজন করছে বন নগরীর ড্যুইসডর্ফ শহরতলীতে অবস্থিত এই ইন্টেগ্রশন হাউজ। এসব আয়োজনের ফলে বাংলাদেশ থেকে জার্মানিতে আসা নতুন মুখগুলো নিজেদের পরিবার ও আত্মীয়স্বজনের অভাববোধ কিছুটা হলেও লাঘব করতে পারছেন এবং নতুন একটি দেশে এসেও একাকিত্বের মনঃকষ্ট কাটিয়ে উঠতে পারছেন।