জার্মানির আন্তর্জাতিক সম্প্রচার কেন্দ্র ডয়চে ভেলের বাংলা বিভাগে কাজ করছেন নুরুন্নাহার সাত্তার গত তিন দশক ধরে। জার্মানিতে এতো বছরের অভিজ্ঞতার নানা গল্প নিয়মিত প্রতিবেদনের মাধ্যমে তুলে ধরেন অনলাইনে। বিগত ১৯৭৫ সালে স্বামীর চাকরির সূত্রে জার্মানিতে পাড়ি জমান। এরপর স্বামী, সন্তান নিয়ে জীবনের বেশিরভাগ সময় কাটিয়ে দিয়েছেন এই সুদূর প্রবাসে। জার্মানদের সুশৃঙ্খল জীবনযাত্রা, ভদ্রতা ও সময়জ্ঞান, পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা, সরাসরি কথা বলা, পরিবেশ সচেতনতা, এসব নানা বিষয় তাকে মুগ্ধ করে। যে কারণে দেশ ছাড়ার পরও কখনো মনে হয়নি যে জার্মানিতে এসে ভুল করেছেন তিনি।
পেশায় গণমাধ্যম কর্মী হওয়ার কারণে জার্মান সমাজের সঙ্গে আরও বেশি করে পরিচিত হতে হয়েছে নুরুন্নাহার সাত্তারকে। তিনি মনে করেন এভাবেই ইন্টেগ্রেশন বা সমাজের অংশভুক্ত হয়ে ওঠা যায়। তবে তার অর্থ এই না যে নিজের সংস্কৃতিকে বিসর্জন দিতে হবে। তার ভাষায়, জার্মান বন্ধু বান্ধব, প্রতিবেশিদের সাথে মিশে বলতে পারি, আমি লাভবানই হয়েছি৷ বিনিময়ে নিজের দেশ সম্পর্কেও জার্মানদের একটা ইতিবাচক ধারণা দিতে পেরেছি।
সীমান্ত: বাংলাদেশীরা এই জার্মান সমাজে কীভাবে মানিয়ে নিচ্ছে?
নুরুন্নাহার সাত্তার: আমার মতে যে কোন দেশে পেশাগতভাবে এবং সামাজিক ক্ষেত্রে নিজের যোগ্যতা অনুযায়ী ইতিবাচক অবদান রাখা সম্ভব। এক্ষেত্রে থাকতে হবে কিছু করার জন্য নিজের তীব্র ইচ্ছাশক্তি।
তবে বেশিরভাগ বাংলাদেশিদের মধ্যে লক্ষ্য করা যায় তারা নিজেদের মধ্যে থাকতেই বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করে। অনেক মানুষকে দেখেছি বহু বছর জার্মনিতে থাকলেও জার্মান ভাষা তেমন না জানা বা জার্মানদের সাথে সেভাবে
না মেশার কারণে এই সমাজ সম্পর্কে তাদের অনেক ভুল ধারণা রয়েছে। তাই আমার মনে হয় নিজের শেকড়কে ভুলে না গিয়ে এদেশিদের সাথে ভালোভাবে মিশতে পারলে সুবিধা কিন্তু নিজেদেরই।
সীমান্ত: এই ক্ষেত্রে বাংলাদেশীদের জন্য কোন বিষয়গুলো বড় বাধা হয়ে ওঠে? ভাষাগত সমস্যা, শিক্ষাগত যোগ্যতা নাকি অন্য কিছু?
নুরুন্নাহার সাত্তার: ভাষা অবশ্যই একটা বড় বাধা যেটা বললাম একটু আগেই। তবে মেশার আগ্রহ থাকলে ভাষা শেখার আগ্রহও বেড়ে যাবে। সবাইকেই যে উচ্চ শিক্ষিত হতে হবে এমন কোনো কথা নেই। যার যা যোগ্যতা তা নিয়েই যে কেউ এগিয়ে যেতে পারে। তার জন্য দেশ জাতি, ধর্ম, বর্ণ কিন্তু বড় বিষয় নয়। নিজস্বতা বজায় রেখে অন্যের ভালোটা গ্রহণ করলে কিন্তু কোনো অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। জার্মানদের সাথে আন্তরিকভাবে মিশে, ওদের জীবনযাত্রার ইতিবাচক জিনিসগুলো শিখেছি ওদের কাছ থেকে। যার ফলে এদেশে আমার চলার পথ অনেক মসৃণ হয়েছে। তাই বলে বিদেশিদের সাথে চলতে গিয়ে কখনো নিজের পরিচয় ভুলে যাইনি। স্থান, কাল, পাত্রভেদে মানুষের আচার আচরণ ভিন্ন হয়ে থাকে। আসলে মানুষ সবাই এক। আমি বিশ্বাস করি, আমার সাথে কে কেমন ব্যবহার করে, তার অনেকটাই নির্ভর করে আমার নিজের আচরণের ওপর।
সীমান্ত : বাংলাদেশ থেকে ইদানীং অনেকে মেয়েই জার্মানিতে এসে আবাস গড়ছে। তাদের কেউ পড়াশোনার উদ্দেশ্যে, কেউবা স্বামীর সঙ্গে বিদেশে পাড়ি দিয়েছে। বিষয়টাকে কীভাবে দেখেন?
নুরুন্নাহার সাত্তার: এটা অবশ্যই একটা ইতিবাচক দিক। যারা পড়াশোনার উদ্দেশ্যে এসেছে তাদের বলবো ভালোভাবে শিক্ষা জীবন শেষ করতে। আর যারা স্বামীর সঙ্গে এসেছেন তারা প্রথমে ভালো করে ভাষাটা শিখে নিয়ে নিজের পছন্দমতো যে কোনো বিষয়ে ট্রেনিং নিতে পারেন, কারণ সে সুযোগ এদেশে সকলের রয়েছে। পরে যেন অনেকের মতো শুরুতে শেখা হয়নি বলে আফসোস করতে না হয়। এ বিষয়ে ছোট্ট করে একটু নিজের কথা বলি। আমি
এদেশে আসার সাথে সাথেই জার্মান ভাষাশিক্ষার কোর্সসহ আর্ট, টাইপ, সেরামিক, সেলাই, ইকেবানা এবং শরীরচর্চার মতো নানা কোর্সে ভর্তি হয়ে গিয়েছিলাম। সে সময় নিঃসন্দেহে কোর্সগুলো আমাকে ভীষণভাবে সাহায্য করেছে। আর হ্যাঁ নিজের প্রবল ইচ্ছা এবং স্বামীর কিছুটা সহযোগিতা পেলে যে কোনো নারীর জন্য সাফল্য নিশ্চিত।
তাছাড়া আজকের এই স্যোশাল মিডিয়ার যুগে সবকিছু এমনিতেই অনেক সহজ হয়ে গেছে।