ডঃ আনাকুটি ভালিয়ামাঙ্গালামের জীবন নানা সংস্কৃতির সাগর পাড়ি দেওয়া এক ছোটখাটো দুঃসাহসিক অভিযান। সত্তরের দশকে তিনি জার্মানি সম্পর্কে খুব অল্প কিছুই জানতেন। তবে নব্বই এর দশকে এসে তিনি জার্মানির বন এবং কোলন নগরীর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর মাতৃভাষা মালায়ালাম শিখিয়েছেন। সেসময় তাঁর স্বামী বন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ছিলেন এবং সেমিস্টারের ছুটিগুলো তিনি স্বামীর সাথে জার্মানিতে কাটাতেন।
দক্ষিণ ভারতের প্রায় শেষপ্রান্তে কেরালার এক ছিমছাম সুন্দর গ্রামে জন্ম এবং সেখানেই কেটেছে তাঁর শৈশব এবং তারুণ্যের বর্ণিল সময়। তবে উচ্চ শিক্ষার জন্য তিনি প্রথম নিজের গ্রাম ছেড়ে উত্তর ভারতে পাড়ি জমান। কেরালা থেকে উত্তর ভারতের বেনারস গমন এবং বারানসিতে তাঁর অবস্থানের শুরুর দিনগুলো ছিল তাঁর কাছে খুব বড় মাপের চ্যালেঞ্জ। বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করে তিনি সেখান থেকেই জার্মান ভাষার উপরে দ্বিতীয় মাস্টার্স করেন।
১৯৭৫ সালে অস্ট্রিয়ায় পিএইচডি করার জন্য বৃত্তি পান। এটা ছিল তাঁর জন্য প্রথম কোন জার্মান ভাষাভাষী তথা ইউরোপীয় দেশ ও সংস্কৃতির সাথে পরিচিত হওয়ার এবং বহুসংস্কৃতির সন্নিবেশ বোঝার মহা সুযোগ। ১৯৭৯ সালে তিনি জালসবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জার্মান ভাষা ও সংস্কৃতির উপর সফলভাবে তাঁর পিএইচডি গবেষণা সম্পন্ন করেন।
এরপর তিনি ভারতে ফিরে গিয়ে বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে জার্মান ভাষা ও সংস্কৃতি বিভাগকে আরও মজবুত করে তোলার জন্য একনিষ্ঠভাবে কাজ শুরু করেন। ১৯৮৭ সালে তিনি মুম্বাই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমন্ত্রণ পান সেখানে বিদেশী ভাষা বিভাগের প্রধান এবং অধ্যাপক হিসেবে যোগদানের জন্য। সেখানে প্রায় ১৫ বছর কৃতিত্বের সাথে দায়িত্ব পালনের পর তিনি প্রফেসর এমেরিটাস ফেলো হিসেবে মর্যাদা পান।
এমেরিটাস ফেলো হিসেবে কাজ করার সময় থেকে তিনি কিছু সময় ভারতে এবং স্বামীর সাথে কিছু সময় জার্মানিতে কাটিয়ে আসছেন। যার ফলে তাঁর জীবনে ঘটেছে আন্তসাংস্কৃতিক সম্মিলন।
এখন পর্যন্ত তাঁর অনুদিত নির্বাচিত কবিতার দুটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। প্রথমটি হলো “সীমানায় অবিশ্বাস”। এটি ২০০৬ সালে জার্মানির হাইডেলব্যার্গ এ অবস্থিত দ্রৌপদী প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত। এ বইটিতে আধুনিক দুনিয়ায় খ্যাতিসম্পন্ন ভারতীয় কবি কে সচিদানন্দন এর নির্বাচিত কবিতাগুলো রয়েছে, যিনি কেরালা থেকে মালায়ালাম ভাষায় কবিতা চর্চা করেন। দ্বিতীয় কাব্য সংকলনটির নাম “এক চিলতে আলো”। এটি ২০১২ সালে একই প্রকাশনী থেকে কবি ও এন ভি কুরুপ এর ৮০টি বাছাইকৃত কবিতা নিয়ে প্রকাশিত হয়। প্রয়াত কবি কুরুপ জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বেশ কিছু সম্মানজনক পদকে ভূষিত হয়েছেন।
সীমান্ত: আপনি কোন প্রেক্ষাপটে জার্মানিতে এসেছিলেন?
আসলে জার্মান ভাষা এবং সাহিত্য নিয়ে আমার পেশাগত কাজের কারণেই জার্মানি তথা জার্মান ভাষাভাষী দেশগুলোর সাথে আমার যোগসূত্র রচিত হয়। তবে জার্মান ভাষা শেখার প্রতি আমার প্রথম আকর্ষণ ও প্রেরণা আসে জার্মান দার্শনিক ইমানুয়েল কাণ্ট এর দর্শন নিয়ে কাজ করতে গিয়ে, যখন আমি বেনারসে ছিলাম। তখন আমরা কাণ্ট এর দর্শন এর ইংরেজি অনুবাদ পড়তাম। কিন্তু আমার প্রবল ইচ্ছা ছিল জার্মান ভাষায় তাঁর মূল লেখাগুলো পড়ার। সেই থেকে জার্মান ভাষা শেখা শুরু। পরে জার্মান ভাষা এবং সংস্কৃতির উপরেই পারদর্শিতা অর্জনের চেষ্টা করি। কাণ্ট কে বোঝা খুবই কঠিন, তবুও আমি মনে করি যে, আমি তাঁকে অন্তত কিছুটা বুঝেছি।
যাহোক, জার্মান এক বিশেষ দার্শনিক ভাষা। উচ্চমার্গের সাহিত্যিক রচনাগুলো বোঝা কঠিন, এমনকি আগ্রহীদের জন্য সেটা একটা বিশাল বড় চ্যালেঞ্জ। আমি এখন নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করি যে, জার্মানির “কবি এবং দার্শনিকদের” সংস্কৃতির সাক্ষী হতে পেরেছি, যারা ভাষা ও সংস্কৃতিতে অত্যন্ত সমৃদ্ধ।
সীমান্ত: কবে থেকে আপনি জার্মান ভাষায় সাহিত্য চর্চা করে আসছেন?
সেই কৈশর থেকেই পদ্য এবং গদ্যের প্রতি আমার দুর্বলতা রয়েছে। তখন থেকেই আমি কবিতা লেখা শুরু করি। আমি প্রায়ই কবিতা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতাম এবং পুরস্কার পেতাম। তবে আমি আমার কবিতা অন্য কাউকে দেখাতে লজ্জা পেতাম, কারণ সেগুলো একান্ত ব্যক্তিগত বিষয় ছিল। সেসময় আমি শুধু মালায়ালাম ভাষায় লিখতাম। পরে অবশ্য মালায়ালাম এবং ইংরেজি দুই ভাষাতেই লিখতে থাকি। আমি মাস্টার্স পড়ার সময় জার্মান ছন্দের সাথে পরিচিত হই এবং নিজে কবিতা লেখার ক্ষেত্রে আরও উৎসাহিত হই। এভাবে আমি ভাঙ্গা ভাঙ্গা জার্মান ভাষায় কবিতা লেখা শুরু করি। জার্মান ভাষা আমার খুব পছন্দের। এর পেছনে অন্যতম কারণ হলো, আমার অনেক অনুভূতি এবং ভাব আমি মাতৃভাষায় অনেকটা দ্বিধার মধ্য দিয়ে প্রকাশ করতে পারি, অথচ জার্মান ভাষায় সেগুলো বেশ সাবলীলভাবে চলে আসে। জালসবুর্গ এ আমি যখন গবেষণার কাজ করছিলাম, সেসময়ই আমার অধিকাংশ কবিতা লিখেছি।
জালসবুর্গ এবং বেনারস এ লেখা আমার কবিতাগুলো নিয়ে ১৯৮৫ সালে প্রথম আমার কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। জার্মানির বিলেফেল্ড নগরীতে অবস্থিত লিঙ্গুয়া প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত এই সংকলনটির নাম “শব্দের মন্দিরে”। ২০১৭ সালে আমি হিল্ডেসহাইমার সাহিত্য সংঘ থেকে হিল্ডেসহাইমার সাহিত্য পুরস্কার লাভ করি। এই ছোট্ট পদকটি আমাকে জার্মান ভাষায় আরও বেশি কাব্য চর্চা করতে উৎসাহ যোগায়।
সীমান্ত: জার্মানিতে ইন্টেগ্রেশনের ক্ষেত্রে সাহিত্য কী ধরণের ভূমিকা রাখতে পারে?
ইন্টেগ্রেশনের জন্য ভাষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একটি নতুন ভাষা শেখার মাধ্যমে আমরা একটি নতুন দেশকে মাতৃভূমির মতো আপন করে নিতে পারি। আমার কাছে, ভাষাই একটি পরম আশ্রয়। ঠিক একইরকমভাবে বর্ণমালা যেন একটি সেতুর মতো, যা আমাদেরকে অন্য মানুষদের কাছাকাছি টেনে আনে। ভাষা জানার মাধ্যমে আমরা সীমানাকে অতিক্রম করতে পারি, আবার সীমান্তের সঠিক মর্মার্থও অনুধাবন করতে পারি। আমরা যখন একটি নতুন ভাষা শিখি, তখন সেই ভাষার সাহিত্য পড়ার মাধ্যমে আমরা তাঁদের মনন ও সংস্কৃতির সাথেও পরিচিত হতে পারি। আমার মতে, জার্মান ভাষা সাহিত্যে অত্যন্ত সমৃদ্ধ। আমি যখন জার্মান শিখেছি, তখন মনে হয়েছে যে, জার্মানি কবি ও দার্শনিকের সূতিকাগার। তবে এখন আমরা এমন এক প্রযুক্তির যুগে প্রবেশ করেছি – যার ছোঁয়া এবং প্রভাব নানাভাবে আমরা উপলব্ধি করি যে, এখন এই দেশটির পরিচিতি প্রযুক্তির দেশ হিসেবে। বিশ্বায়নের ফলে এখন বিভিন্ন ভাষা এবং সাহিত্য বেশ সহজলভ্য হয়ে গেছে। অভিবাসীদের মাধ্যমে ভাষা ও সংস্কৃতিও আজ একদেশ থেকে আরেক দেশে পৌঁছে যাচ্ছে। আমি মনে করি, এই প্রবণতাকে হুমকি মনে না করে বরং সুযোগ এবং সম্প্রসারণ হিসেবে দেখা উচিত। আমি মনে করি যে, ইন্টেগ্রেশন একমুখী পথ নয়, বরং পারস্পরিক সম্পর্ক, দ্বিপাক্ষিক বোঝাপড়া এবং পারস্পরিক উদারতার বিষয়। সবচেয়ে বড় কথা হলো, ইন্টেগ্রেশন হচ্ছে পারস্পরিক মেলামেশা, যা একালাপের মধ্য দিয়ে নয় বরং দ্বিপাক্ষিক আলাপচারিতার মধ্য দিয়ে ঘটে এবং মতবিনিময়ের মধ্য দিয়ে সম্ভব হয়। সেই কারণে কবিতা-গল্প ইন্টেগ্রেশনের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। আমার মতে, সাহিত্য ইন্টেগ্রেশনের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে, বিশেষ করে, আমাদের কেমন হতে হবে সেই পথ-নির্দেশনা দেয়।
সীমান্ত: সীমানায় অবিশ্বাস শিরোনামে আপনি একটি কাব্যগ্রন্থ অনুবাদ করেছেন। আপনার মতে সীমান্ত কি শুধু মানুষকে পৃথক করে নাকি কাছে টেনেও আনে?
এই কাব্যগ্রন্থটি অনুবাদ করার সময় জার্মান ভাষায় সকল শব্দের প্রতিশব্দ খুঁজে পাওয়াটা সহজ মনে হয়নি। তথাপি মানুষকে এমন একটি শব্দকে বেছে নিতে হয়, যা মূল রচনার মর্মার্থ ঠিক রাখে এবং লক্ষিত জনগোষ্ঠীর ভাষাতেও (এক্ষেত্রে জার্মান) সঠিক ধারণা বোধগম্য হয়। অনুবাদ এক ধরণের আলাপন, যেন দুটি পর্যায়ের সংলাপ, একদিকে কবি ও কবিতার মাঝে আলাপন আবার অন্যদিকে দুই ভাষার মধ্যে সমঝোতা। এটা তোমার আর আমার মধ্যে সংলাপ। ভাষা একটি জীবনমুখী ব্যাপার। এভাবে অনুবাদ একটি মিলন ঘটায়, তবে নিজস্বতা বিলীন করে নয়, বরং একটি বিচ্ছিন্নতাও থাকে। এই প্রক্রিয়ায় সীমান্ত রেখা বা সীমানা কিছুটা দূরে সরানো যায় বা কিছুটা অতিক্রম করা যায়। যাহোক, মানুষের মনন ও চেতনা সীমান্তকে মাড়িয়ে কিংবা সীমান্তের বাধা ভেদ করতে পারে, যার অর্থ দাঁড়ায় “সীমান্তে বা সীমানায় অবিশ্বাস”। এই কবির কবিতা পাঠের আসর থেকে আমার মনে হয়েছে যে, উপস্থিত শ্রোতা ও দর্শকেরা মর্মার্থের ভিন্নতা সত্বেও বেশ উপভোগ করেছেন।