দাসত্ব আর কাঠামোগত শোষণ: অতীত ও বর্তমান
শ্যার্ষ পালাজি
”…এই পুরনো সাপ নতুন কোন খোলসে উদয় হবে?”, ১৮৬৫ সালে আমেরিকায় দাস প্রথা বিলুপ্তির সময় আফ্রো আমেরিকান ডগলাস ফ্রেডেরিক এমন প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছিলেন। এই যুগে পশ্চিমা দেশগুলোতে অনেকেই যখন ”দাস” শব্দটা শুনে তখন খুব কম মানুষের মনেই ভেসে ওঠে না আফ্রিকার তুলা ক্ষেতের মানুষগুলোর কথা। আমিস্টাড কিংবা টুয়েল্ভ ইয়ার্স স্লেভ এর মত সিনেমাগুলোতে সেরকম দাসদেরই ছবি দেখা যায়। যখন কেউ কারো হয়ে কাজ করতে না চাইলে ক্ষেপে গিয়ে বলে “আমি কি তোমার নি…(কালো মানুষদের জন্য বর্ণবাদী শব্দ আমরা এখানে ব্যবহার করতে চাই না), তখন এই ধরণের শব্দ ব্যবহার বুঝিয়ে দেয় যে দাস এবং কালো মানুষ এই দুটো জিনিষ মানুষের মাথার ভেতরে এখনও কীভাবে আটকে আছে। বর্ণবাদ এবং পশ্চিমা জগতের সৃষ্টি করেছিলো যে অতলান্তিকের দুই পাড়ের দাসত্বের অর্থনীতি, সেটা যেহেতু এখন অতীত হয়ে গেছে তাই খুব কম মানুষই এখন দাস প্রথা নিয়ে ভাবে।
তবে এই দাস প্রথা এবং আরও নানা ধরণের কাঠামোগত শোষণ আজও বজায় রয়েছে – সারা বিশ্বেই। সারা দুনিয়ার দুই থেকে পাঁচ কোটি মানুষ আধুনিক দাস প্রথার মধ্যে বাস করছে। এই সংখ্যা এর চেয়ে কম না আবার বেশিও না। এই কাঠামোগত শোষণের সীমারেখা (যার শিকার আরও বহু মানুষ) আর দাস প্রথার ‚আধুনিক‘ সংজ্ঞা ক্রমাগত পরিবর্তনশীল। অর্থব্যবস্থা প্রভাবিত এই মানবতার অবমূল্যায়নকে ঠেকাতে আমরা কী করতে পারি?
এই ধরণের দাস প্রথা ও শোষণ তথাকথিত উচ্চ সংস্কৃতির শুরু থেকেই আছে। মানে অন্তত ১০ হাজার বছর থেকে। তবে এটা পশ্চিমাদের আবিষ্কার নয়, যদিও অতলান্তিকের দুই পাড়ের এই দাস প্রথা ভিত্তিক অর্থনীতি মানব শোষণের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল। বর্তমান যুগে আমরা সেই পুরণো সভ্যতার বড় বড় স্মৃতিস্তম্ভগুলো দেখে বিষ্ময়ে হতবাক হয়ে যাই। কিন্তু সস্তা শ্রম না থাকলে এই সব বিশাল সৌধগুলোও তৈরি করা সম্ভব হতো না।
গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, অতলান্তিকের দুই পাড়ের দাস প্রথা অর্থনীতির কারণে গড়ে ওঠার ধারণার বিপরীতে মূলত নারী এবং শিশুরাই এই কাঠামোগত শোষণব্যবস্থার শিকার হয়েছে। এছাড়া কাঠামোগত শোষণব্যবস্থার ধরণগুলো কখনো একইরকম থাকে না এবং সাধারণত নৃতাত্বিকভাবে বাহ্যিক সংজ্ঞার মধ্যে ফেলা যায় না। এছাড়া আইনগতভাবে সুরক্ষিত দাস প্রথার একটি ধরণ রয়েছে যেখানে একজন আনুষ্ঠানিকভাবেই আরেকজনের মালিক হয়ে বসে থাকে। বর্তমান যুগের ”আধুনিক” দাস প্রথার অন্তত দশ শতাংশ এই ধরণের মধ্যে পড়ে যাবে। সাধারণত কোন মানুষকে যখন কোন কাঠামোর মধ্যে ফেলে শোষণ করা হয় সে তত বেশী শেকড়হীন হয়ে পড়তে থাকে। শরণার্থীরা এই শোষণের বিশেষ শিকার হয়ে পড়েছে। ইউরোপের বিভিন্ন দেশ বিশেষ করে স্পেন এবং ইটালিতে ক্ষেত খামারে কাজ করতে আসা মানুষগুলোর দিকে এক নজর তাকালেই বিষয়টা স্পষ্ট হয়। এমনকি জার্মানির নানা অর্থনৈতিক ক্ষেত্র থেকে শুরু করে শ্রম নির্ভর ব্যবসা বাণিজ্যের চেহারাটাও আজ ভিন্ন রকম দেখাতো যদি এই আন্তর্জাতিক সস্তা শ্রমিকদের দেখা না মেলতো। সংঘবদ্ধ ভিক্ষাবৃত্তি, জোরপূর্বক বিয়ে আর মানব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ চোরাচালানও এই তালিকার বাইরে নয়।
কাঠামোগত শোষণের এই বৈশ্বিক ধরণটা সবসময় একই রকম যুক্তি দিয়ে থাকে: কোথায় আমি কম খরচে উৎপাদন করতে পারবো? কোন ধরণের শ্রমিক দিয়ে? এবং কীভাবে আমি পণ্য বিক্রি থেকে সবচেয়ে বেশি লাভ করতে পারবো? বৈশ্বিক পর্যায়ে এই বৈষম্যের কারণে আমরা বর্তমানে অতি মাত্রায় ভোগের অভ্যাস দেখছি যেটা উপনিবেশ আমলে বৈষম্যের কারণে সৃষ্ট। কফি, চকলেট, গাড়ি, স্মার্টফোন সবকিছুই অনেক বেশি দুর্লভ হতো যদি আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সংস্থাগুলো বাকি সবাইকে সমান ভাবে দেখতো, যদি তাদের শ্রমবাজারে কোন ধরণের শোষণ না থাকতো। আন্তর্জাতিক ফোরামে দেশগুলো টেকসই উন্নয়নের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ যার মূল উদ্দেশ্যে হচ্ছে দেশগুলোর মধ্যে বৈষম্য কমিয়ে আনা। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার ৮ ধারার ৭ উপধারায়, ”জোরপূর্বক শ্রম, আধুনিক দাসপ্রথা এবং মানব পাচার রোধের জন্য অবিলম্বে সব ধরণের পদক্ষেপ নেওয়ার“ কথা বলা হয়েছে। তবে এটির বাধ্যবাধকতা বলতে গেলে খুব অল্পই।
অর্থনৈতিক স্বার্থ এবং নৈতিকতা কত দ্রুত একে অপরের মুখোমুখি হয়ে যেতে পারে তার উদাহরণ সম্প্রতি দেখা গেছে জার্মানিতে পণ্য সরবরাহ সংক্রান্ত এক আইনে। এতে মানুষ এবং পরিবেশ শোষণ যতটা সম্ভব কমিয়ে আনার কথা বলা হয়েছে। তবে ২০২০ সালে জার্মানির কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রণালয় এই ব্যপারে তাড়াহুড়া না করার উপদেশ দেয় এবং বিশ্ব মহামারির প্রেক্ষিতে মন্দাভাব হতে পারে বলে সতর্ক করে দেয়। তার মানে হচ্ছে, সামাজিক এবং পরিবেশ সংক্রান্ত নীতি ধরে রাখা, তবে ততটুকু যতটুকুতে অর্থনীতির ক্ষতি না হয়। এভাবে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে কাঠামোগত শোষণের ধারাটা বৈশ্বিক পণ্যমাণের স্বার্থে ধরে রাখা হয় এমনকি মজবুত করা হয়। অবশ্যই স্থানীয় পর্যায়ে উপকারভোগী অনেক মানুষ রয়েছে কিন্তু আসল সম্পদটা অন্য কোন জায়গায় মজুদ করা হচ্ছে। এই ধরণের কাঠামো শরণার্থী এবং অভিবাসনের একটি বড় কারণ। যাই হোক, আমাদের একটি আইন রয়েছে, এটাকেও একটি শুরু হিসেবে দেখা যেতে পারে।
এই আধুনিক দাসপ্রথা আর কাঠামোগত শোষণ কি আমরা শেষ পর্যন্ত রোধ করতে পারবো? হ্যাঁ, ব্যক্তিগত জীবনে সামর্থ্যানুযায়ী ভোগাভ্যাসের মাধ্যমে, নিজেদের ইচ্ছাকে নিয়ন্ত্রণ করার মাধ্যমে। আমি একটা কলা কিংবা কফি যা-ই কিনি না কেন তার পেছনে যদি কোন মানুষকে শোষণ করা না হয় এবং পরিবেশ রক্ষার কথা চিন্তা করা হয়। কিন্তু এটাই কি যথেষ্ট? না, ন্যায্যমূল্যের ব্যবসা যেটা এখনও জার্মানির বাজারের এক শতাংশ মাত্র। এবং যেমনটা ওপরে বলা হয়েছে, এই বৈশ্বিক শোষণ কাঠামোর বাইরেও এমন কিছু রয়েছে যেটা আমাদের ঘরে সামনেই পাওয়া যায়। মূলত অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির দোহাই দিয়ে তৈরি করা এই ঐতিহাসিক নির্ভরতা কাটাতে হলে আমাদের আরও অনেক দূর যেতে হবে। এবং এজন্য আবার আমাদের চিন্তাটা একটু বদলাতে হবে এবং সেটা পাঠশালা থেকেই। ভালো থাকার মানে বলতে আমরা কী বুঝবো? আমাদের ”জীবন ধরণ“ এর সাফল্য মাপার মাপকাঠি কী কম খরচে কেনাকাটা করতে পারা, যার মূল্য আসলে অন্যদেরকে দিতে হয়? কতদিন আমরা এর সঙ্গে যুক্ত অন্ত এবং আন্তসামাজিক উত্থানপতনকে উপেক্ষা করে যেতে পারবো? উত্তর এবং দক্ষিণ গোলার্ধের দেশগুলোর সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি, সংগঠন এবং উদ্যোগগুলো এই ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে যারা রাজনীতি এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে চিন্তার পরিবর্তনে সাহায্য করতে পারে।