রিয়াজুল ইসলাম
আমাকে দেখার আগেই মহিলাকে আমি দেখতে পেলাম। রাস্তার এপাশ থেকেই বোঝা যাচ্ছিলো সে পথ হারিয়েছে। বোঝা যায়, তার বয়স অনেক হয়েছে। কিন্তু চেহারায় বিগত যৌবনের রুপ আর আভিজাত্যের ছাপ এখনও আছে।
এবার আমার দিকে তিনি তাকালেন, রাস্তার ওপাশ থেকেই চেঁচিয়ে বললেন, “হিল্ফে”, মানে সাহায্য। বার বার হিল্ফে বলে আমার দিকে চেঁচাচ্ছিলেন। তার পেছন থেকেই আরেকটা মেয়ে আসছিলো। কিন্তু বৃদ্ধার দিকে তার নজর নেই। আর বৃদ্ধাও যেন মনে হয় আমাকেই শুধু দেখতেে পেয়েছেন। রাস্তা পার হয়ে ওইপাশে গেলাম। বাচ্চাকে কিন্ডারগার্টেন থেকে আনতে হবে। বেশি সময় নেই হাতে। কিন্তু এই বৃদ্ধাকে অসহায় অবস্থায় ফেলে চলে যেতে পারলাম না।
কাছে আসতেই তিনি আমার হাতটা ধরে ফেললেন। কাতর কন্ঠে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “আমি কোথায়?”
“আপনি কি পথ হারিয়েছেন?”, জিজ্ঞেস করলাম।
“হ্যা, আমি কোথায়”
আমি রাস্তার নাম বললাম। একটু সামনেই একটা পুনর্বাসন কেন্দ্র। আমি প্রায় নিশ্চিত ছিলাম বৃদ্ধা নিশ্চয় সেখান থেকে হাঁটতে বের হয়ে এখন তালগোল পাকিয়ে ফেলেছে।
কিন্তু বৃদ্ধা তার নাম বলতে পারলো না। আমি জিজ্ঞেস করলাম, “আপনি কি পুনর্বাসন কেন্দ্র থেকে এসেছেন।”
কিন্তু উত্তর দেওয়ার বদলে এবার সে কাঁদতে শুরু করলো।
“আমার ছেলে আমাকে ফেলে চলে গেল কেন?, কতবার বলছি আমাকে একা রেখে যাবি না”।
এবার আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। ভরদুপুরের রোদ বৃদ্ধার মাথার ওপর এসে পড়ছে। সাদা চুলগুলো একদম পাতলা হয়ে গেছে। রোদে সেই সাদা চুলগুলো আরও সাদা দেখাচ্ছে। আমি তাকে হাত ধরে বললাম, “চলেন সামনে আমি আপনাকে বাসায় পৌছে দেই।”
বলতে বলতেই সামনের একটা দোতলা পুরনো বাড়ির গেটের সামনে চলে আসলাম। মহিলা বললো এটাই তার বাসা। এবার সে চিনতে পেরেছে। তার মানে বাড়ির গেট থেকে বের হয়ে পঞ্চাশ কদমের মধ্যেই সে দিক হারিয়ে ফেলেছিলো।
এবার ভাবলাম, ঠিক আছে। এবার বোধহয় মহিলা শান্ত হবে। কিন্তু উল্টো সে আবারও কাঁদতে শুরু করলো।
“কিন্তু আমার ছেলে আমাকে ফেলে চলে গেল কেন? কতবার তাকে বলছি, দরকার হলে একটা কাজের লোক রাখতে। আমি টাকা দেব। কিন্তু এখন তো সে চলে গেছে।”
আমার ভয় হলো মহিলার ঘটনা আসলে সেটাই না হয়ে যায়। এদেশে এটা অসম্ভব কিছু না। আমি তাকে অভয় দিয়ে বললাম, “না,না, আপনার ছেলে চলে আসবে। “
কিন্তু বৃদ্ধা নাছোড়বান্দা। সে আমাকে ছাড়লো না।
“আপনি যাবেন না, এখানে একটু বসেন, একটু পানি আছে, খাবেন?” বলেই আমাকে দরজার পাশে রাখা একটা বোতল দেখিয়ে দিলো।
“না না, আপনি ব্যস্ত হবেন না। “
“আপনি কোথায় থাকেন”, এই নিয়ে তৃতীয়বারের মত মত সে আমাকে জিজ্ঞেস করলো।
“বেশি দূরে না, এই পাহাড়ের ঢালু বেয়ে নিচে নামলেই আমার বাসা”।
“আপনি কি আমার এখানে থাকবেন, আমি আপনাকে টাকা দিবো। আমার স্বামী সরকারি চাকুরে ছিলো।” বৃদ্ধা আমার দিকে তাকিয়ে বললো।
“আপনার ছেলের কোন ফোন নম্বর নেই? তাকে ফোন করেন”।
“হ্যা, ওতো ফোন নম্বরটা কোথায় যেন লিখে রাখছে”, বলেই ঘরের দরজার ভেতরে ঢুকতে গেলো। কিন্তু পরেই আবার বের হয়ে আসলো। আমাকে বললো,
“আপনি কিন্তু এখানেই থাকবেন, চলে যাবেন না।”
“না, না। আমি যাবো না। আপনি ফোন নম্বরটা নিয়ে আসেন আমি আপনার ছেলেকে ফোন করি। “
“কিন্তু ও আমাকে একা রেখে চলে গেল কেন, ওকি আর আসবে না?”
“আসবে আসবে”, আমি বললাম। এদিকে আমার বাচ্চার কিন্ডাগোর্টেনের সময় প্রায় শেষ, কয়েক মিনিট বাকি। আমি বৃদ্ধাকে বললাম,
“আমার বাচ্চাকে কিন্ডারগার্টেন থেকে আনতে হবে। আমি এখন যাই?”
কিন্তু বৃদ্ধাকে যেন একা থাকার আতঙ্কে পেয়ে বসেছে। সাথে সাথে আর্তনাদ করে উঠলো।
“দয়া করে আপনি আরও কিছুক্ষণ থাকুন।” বলেই আবারও কাঁদতে শুরু করলো। “আমার ছেলে কেন আমাকে রেখে চলে গেল”।
“আপনার ছেলে বোধহয় কেনাকাটা করতে গেছে। একটু পরেই চলে আসবে। “
“না, ও আমাকে ফেলে চলে গেছে”, নাছোড়বান্দার মত তার উত্তর।
কিন্ডারগার্টেনে ফোন করলাম, বললাম আমি এখানে আটকে গেছি, কয়েক মিনিট দেরি হবে। অসহায় বৃদ্ধাকে একা ফেলে যেতে পারছি না। আমার নিজের ছেলেও নিশ্চয়ই এভাবে আমার জন্য অপেক্ষা করছে। এভাবেই কেটে গেলো কয়েক মিনিট। না, এবার আমাকে যেতে হবে, এমনটি ভাবছি এমন সময় একটি গাড়ি রাস্তা থেকে ধীরে ধীরে বাড়ির আঙ্গিনায় ঢুকলো। পঞ্চাশোর্ধ এক ভদ্রলোক গাড়ি চালাচ্ছেন। “আপনি কি ওনার ছেলে?”, জিজ্ঞেস করলাম। মহিলার দিকে একবার তাকিয়ে তারপর আমাকে হেসে বললো, “কী, পথ হারিয়ে ফেলেছিলো?” স্বস্তির নিশ্বাস ছেড়ে এবার তাকে সব খুলে বললাম। মায়ের কাছে গিয়ে সে বললো, “মা, তোমাকে না কতবার বলছি, একা একা বের হবা না”। “কিন্তু তুই তো আমাকে একা রেখে চলে গিয়েছিলি।” “ওহ মা, আমি তো একটু পরেই চলে আসতাম। ” “না, তুই আমাকে একা রেখে যাবি না।” মা-ছেলের কথাবার্তা অস্পষ্ট হয়ে এলো। কারণ ততক্ষণে আমি ছুটতে শুরু করেছি। আমার নিজের ছেলে যে অপেক্ষা করছে।