বিগত ১৮ বছর ধরে জার্মানিতে বসবাস করছেন আদনান সাদেক। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় যা বুয়েট নামে বেশি পরিচিত সেখান থেকে ব্যাচেলর করে মাস্টার্স করতে ২০০২ সালে জার্মানিতে আসেন। কেবল ভালো ছাত্রই নন, একজন তথ্য প্রযুক্তিবিদ এবং ক্রীড়া সংগঠক হিসেবেও বেশ পরিচিত তিনি। জার্মানির নামকরা একাধিক প্রতিষ্ঠানে চাকরি করার পর ২০০৯ সালে নিজের উদ্যোগে একটি সফটওয়্যার কোম্পানি চালু করেন। তিন কন্যা সন্তান এবং স্ত্রীকে নিয়ে বাস করছেন বর্তমানে স্টুটগার্ট শহরে। কেবল বাংলাদেশিদের মধ্যেই নয়, জার্মানির মূলধারার নানা কর্মকাণ্ডে নিজেকে সম্পৃক্ত করে এই সমাজের একজন হয়ে উঠেছেন আদনান সাদেক। তার সঙ্গে কথোপকথনে উঠে আসে জার্মানিতে বাঙালী সমাজ এবং জার্মান সমাজে তাদের ইন্টেগ্রেশন প্রসঙ্গ।
সীমান্ত: একজন প্রবাসী বাংলাদেশী হিসেবে জার্মান সমাজে ইন্টেগ্রেশন বা অংশভুক্ত হয়ে ওঠা বলতে আপনি কী বুঝেন?
আদনান সাদেক: সমাজে অংশগ্রহণ করা বলতে মূলত অন্যের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দায়িত্ব ভাগ করে নেয়া বুঝি। সাধারণত বিদেশে গেলে সবাই প্রথমেই আমি কি পাব, এই ভাবনাতে ডুবে থাকে। শুধু নিজে পাওয়া নয়, বরং নিজে কিছু দিতে হবে এই ভাবনা এবং সেই লক্ষ্যে কাজ করাই আমার মতে সমাজে অন্তর্ভুক্তির পূর্বশর্ত।
সীমান্ত: প্রবাসীরা, বিশেষ করে বাংলাদেশীরা, এই ভিন্ন সমাজে কীভাবে ইতিবাচক অবদান রাখতে পারে বলে আপনি মনে করেন?
আদনান সাদেক: যেটা উপরে বললাম, অবদান বলতে দায়িত্ব ভাগ করে নেয়া। ইতিবাচক অবদান রাখা এতো সহজ কাজ নয়। অথবা বলা যায়, ইতিবাচক ভূমিকা রাখার আগে নিজেকে এই দেশের সংস্কৃতি অনুসারে গড়ে তুলতে হবে। একজন জার্মান যেমন কলার ছোলা পকেটে নিয়ে ঘুরে পরবর্তী ময়লার বাক্স না পাওয়া পর্যন্ত, বা রাস্তায় গাড়ি না থাকা স্বত্বেও লাল বাতি দেখলে অপেক্ষা করে, কিংবা যথেষ্ট সাচ্ছল্য থাকা সত্ত্বেও বিদ্যুত, পানি ইত্যাদির ব্যবহারে মিতব্যয়ী হয়, বা প্রতিবেশীর অসুবিধের কথা ভেবে গানের ভলিয়ুম কমিয়ে রাখে, ব্যাক্তিগত ভাবে কাউকে কথা দিলেও ঘড়ির কাটা ধরে হাজির হয় – এই রকম অনেক বিষয় অভ্যেসে পরিণত করার পরেই সমাজে ইতিবাচক ভূমিকা রাখার কথা ভাবা যেতে পারে।
সীমান্ত: আপনার আশেপাশের পরিচিত বাংলাদেশী প্রবাসীরা কীভাবে এই জার্মান সমাজে মানিয়ে নিচ্ছে?
আদনান সাদেক: আমার পরিচিত জগতে বাংলাদেশীদের ৯৯% এই দেশের সমাজভূক্ত নয়। মানিয়ে নিচ্ছে যতটুকু না নিলেই নয়, যাকে বলে অনেকটা জোর করে করা। বাংলাদেশীরা বেশীরভাগ ক্ষেত্রে শুধু নিজেদের মধ্যেই মেলামেশা করে, যার কারণে জার্মান ভাষা শেখা এবং জার্মান সমাজের সাথে যোগসূত্র সাধারণত আমাদের খুব কম।
সীমান্ত: জার্মান সমাজে মানিয়ে নেওয়ার বেলাতে তাহলে তাদের জন্য কোন বিষয়গুলো বড় বাধা হয়ে ওঠে? ভাষাগত সমস্যা, শিক্ষাগত যোগ্যতা নাকি অন্য কিছু?
আদনান সাদেক: এর মূল কারন জার্মান ভাষা বা সংস্কৃতি নয়, যদিও অনেকে ভাষা খুব কঠিন বলে দায়ী করার চেষ্টা করে। আমার অভিজ্ঞতায় বলে এর একমাত্র কারন সমাজের সাথে ইন্টেগ্রেটেড হবার নিজস্ব ইচ্ছাশক্তির অভাব।
সীমান্ত: জার্মানিতে অনেক ধরণের অভিজ্ঞতা আপনার হয়েছে? এইক্ষেত্রে বিশেষ কোন ঘটনা কি আপনি মনে করতে পারেন?
আদনান সাদেক: জার্মানিতে প্রথমদিন ফ্রাঙ্কফুর্টে যখন নামি, ট্রেনের জন্য অনেকটা সময় বিশাল রেলওয়ে স্টেশনে অপেক্ষা করছিলাম। কোনমতে দুইটা সুটকেস নিয়ে প্ল্যাটফর্ম পর্যন্ত এসেছি, তখনও দুই ঘণ্টা বাকি ট্রেনের। আমাকে যেতে হবে ড্রেসডেন। মাঝে লাইপজিগে একবার ট্রেন বদলাতে হবে, এর জন্য মাঝে ২০ মিনিট সময় আছে। একটু টেনশন হচ্ছিলো। যদি কিছু একটা ঝামেলা হয়ে যায়, যদি ট্রেন লেট করে, যদি যে ছেলেটা আমাকে নিতে আসবে সে আসতে দেরী করে…আমার এখনও কোন রুম ঠিক হয়নি, গিয়ে কোথায় থাকব সেটাও তখনো জানিনা।
হঠাৎ লাউডস্পিকারে ঘোষণা এলো- ট্রেন পনের মিনিট মত লেট, তবে পরের কানেক্টিং ট্রেন পাওয়া যাবে। মাঝে ২০ মিনিটের জায়গায় এখন অবশ্য আর মাত্র ৫ মিনিট সময় থাকবে। ট্রেনে চড়ার পর আমার পাশের একজন জার্মানের সাথে পরিচয় হল, ভদ্রলোক কোলনে থাকেন। অফিসের কাজে লাইপজিগ যাচ্ছেন। আমাকে লাউডস্পিকারের ঘোষণাটা বুঝিয়ে বললেন। আমাকে একটু নার্ভাস দেখে ভরসা দিলেন, লাইপজিগে ৪ নম্বর প্লাটফর্মে নেমে ৫ নম্বরে গিয়ে ড্রেসডেনের ট্রেন বদলাতে হবে, খুব সহজ একটা ব্যাপার। ভদ্রলোককে অবশ্য আমার দুইটা সুটকেসের গল্প তখনো বলা হয়নি। হাতের বাইসেপগুলো টেনে হালকা ব্যায়াম করতে আরম্ভ করলাম, ৫ মিনিটে ৭০ কেজি ওয়েট লিফট এবং নতুন ট্রেনে ওঠা!
লাইপজিগ স্টেশনে ৪ নং প্লাটফর্মে নেমে তিন মিনিট কেটে গেল এটা বুঝতে যে, আমাকে সিঁড়ি দিয়ে নেমে একটা টানেলের ভেতর দিয়ে পাশের ৫ নং প্লাটফর্মে যেতে হবে। মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা-র মতন আবার সেখানে কোন লিফট নেই (সাধারণত জার্মানির সব আধুনিক স্টেশনেই প্লাটফর্ম বদলানোর জন্য লিফট থাকে)। আমি একটা সুটকেস উপরে রেখে অন্য সুটকেসটা টেনে নিচে নামালাম। আবার এক দৌড়ে উপরে উঠে গিয়ে পরেরটা নামালাম। একবার ভয় হল, আবার কেউ সুটকেস নিয়ে চলে যায় যদি! সিঁড়িটা অনেক দীর্ঘ- কম করেও ৩০টা ধাপ হবে। দুইবার উঠে নেমে আমার গা ঘেমে উঠল। ৫ নম্বরের সামনে এসে দেখলাম আবার সেই ৩০ ধাপের সিঁড়ি, এইবার উপরে তোলার পালা। প্রথম সুটকেস উঠানোর পর দেখলাম ট্রেন ছাড়ি ছাড়ি করছে। পরেরটা উঠাতে উঠাতে নিশ্চিত মিস করব, এরপর কি হবে ভাবতে ভাবতে গলাটা শুকিয়ে এল। এমন সময় অবাক হয়ে খেয়াল করলাম, অন্য সুটকেসটা নিয়ে কে যেন আমার পাশে দাঁড়িয়ে। কিছু বুঝে উঠার আগেই আগন্তক হুড়োহুড়ি করে আমাকে দুই সুটকেসসহ ট্রেনে তুলে দিল।
আমি ঢুকতেই ট্রেন ছাড়ল, দরজার কাঁচের ভেতর দিয়ে বাইরের সেই সহৃদয় মানুষটির দিকে তাকালাম। আগের ট্রেনে পরিচিত হওয়া সেই ভদ্রলোক আমার দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে হাত নাড়ছেন। চেনা নাই জানা নাই, কই ভাবছিলাম নিচে রাখা সুটকেসটা একা পেয়ে কেউ আবার নিয়ে যায় কিনা। আর সেই অজানা সহযাত্রী আমাকে ট্রেনটা মিস হতে দিলেন না। আমার চোখদুটো এক অজানা ভাললাগায় আদ্র হয়ে উঠেছিলো।
সীমান্ত: জার্মানিতে এত বছরের প্রবাস জীবনেবর্ণবাদের মত কোন ঘটনার মুখোমুখি কি আপনাকে কখনো হতে হয়েছে? যদি হয়ে থাকেন, সেটা কী ধরণের ছিলো?
আদনান সাদেক: না, এমন ঘটনা ১৪ বছরে হয় নি। একবার নূর্নবার্গে রেলস্টেশনে একটা টিনএজ মেয়ে আমাদের উদ্দেশ্য করে জার্মান ভাষায় বিদেশী হিসেবে কিছু খারাপ কথা বলছিল। তার বক্তব্য ছিল বিদেশীরা সব চাকরী নিয়ে নিচ্ছে এবং এই বিদেশীরা এক বর্ণও জার্মান বলতে পারে না ইত্যাদি। আমি সরাসরি মেয়েটির কাছে গিয়ে নিখুঁত জার্মানে জানতে চাইলাম তার এই মতামতের কি কারণ। সে লজ্জা পেয়ে আমতা আমতা করে চলে গেল। এটা ঠিক রেসিজম মনে হয় না, এই জাতীয় ঘটনার জন্য বরং বিদেশীরাও, বিশেষ করে এখানে আশ্রয় নিতে আসা অধিবাসীরাও সমান দায়ী।