প্রায় পাঁচ দশক ধরে বাংলাদেশীরা জার্মানিতে পাড়ি দিচ্ছেন। বিয়ে-শাদি, চাকরি কিংবা ব্যবসার সুবাদে এখানেই বসত গেড়েছেন। তাদের সন্তানরা এখন বিদেশে দ্বিতীয় প্রজন্মের প্রতিনিধিত্ব করছে। তবে এক অদ্ভূত টানাপোড়েনের মধ্যে বাস এই দ্বিতীয় প্রজন্মের। নিজ জন্মভূমি নাকি পিতৃপৃরুষের ভূমি, কাকে প্রতিনিধিত্ব করছে তারা? ইন্টেগ্রেশন নিয়ে আলোচনায় জার্মানিতে এই প্রশ্নটা প্রায়ই ছুঁড়ে দেওয়া হয়।
দুরত্ব আর ব্যস্ততা, এই দুই বাস্তবতার চাপে পড়ে প্রবাসীরা তাদের সন্তানদের কাছে নিজ দেশকে পরিচয় করিয়ে দিতে পারেন খুব কম। ফলে দেখা যায়, এই দ্বিতীয় প্রজন্মের অনেকেই বাঙালী সংস্কৃতি তো দূরের কথা বাংলাটাও বলতে পারে না। বছরে দুয়েকটা বাঙালী অনুষ্ঠানে যোগদান আর ঘরে দেশী খাবার, বাংলাদেশ কিংবা বাঙালী সংস্কৃতি তাদের কাছে এতটুকুই। দ্বিতীয় প্রজন্মের মধ্যে খুব কমই রয়েছেন যারা দুটো ভিন্ন দেশের সঙ্গে একসাথে তাল মিলিয়ে নিজেকে তুলে ধরেছেন। তাদের একজন তিয়াসা হোসনে আইয়ুব। জার্মানিতে জন্ম, এখানেই বড় হওয়া। পেশায় তিনি একজন চিকিৎসক। বন শহরের বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত তিনি। গাইতে ভালোবাসেন রবীন্দ্র সঙ্গীত। বাচ্চাদের শেখান দেশীয় নৃত্য। স্বামী মোঃ খুরশীদ হাসান, যিনি নিজেও একজন প্রবাসী বাংলাদেশী পরিকল্পনাবিদ। সীমান্ত ম্যাগাজিনের সঙ্গে আলাপচারিতায় তিয়াসা তুলে ধরেছেন কীভাবে জার্মানি আর বাংলাদেশ তার কাছে নিজের দেশ হয়ে উঠেছে।
সীমান্ত: আপনি কীভাবে বাংলা শেখা শুরু করেন?
তিয়াসা: আমার বাংলা শেখা মায়ের কাছে। জার্মানিতে স্কুলে যাওয়ার আগেই আমি বাংলা লিখতে পড়তে শুরু করি। আর চার বছর বয়স থেকে তো গান শেখার শুরু। মায়ের কাছে শুনেছি, ছোটবেলাতে অনেক সময় স্কুল থেকে বাসায় ফিরে আমি নাকি বাংলা বলতে চাইতাম না। কিন্তু জার্মান বলতে গেলে আমার বাবা-মা আমাকে বাংলাতেই উত্তর দিতেন এবং বাংলা বলতে বলতেন। এছাড়া আমি দেশে আমার আত্মীয় স্বজনদের বাংলাতে চিঠি লিখতাম। তবে মজার ব্যাপার হলো, বাংলাদেশে অনেকেই আমাকে দেখে বুঝতে পারে না যে আমি জার্মানি থেকে এসেছি। আর আমিও দেশী পোশাক পরতে ভালোবাসি, তাই হয়তো অনেকের কাছে প্রথম নজরেই ধাক্কা লাগে।
সীমান্ত: তাহলে আপনি কোনটা, বাঙালী নাকি জার্মান?
তিয়াসা: আমি আসলে দুটোই। ঘরে আমি একেবারেই বাংলাদেশী, আমি বাংলা বলতে পছন্দ করি। আর বাইরে কাজের বেলাতে আমি জার্মান। অনেক ক্ষেত্রে জার্মানদের চেয়েও বেশি জার্মান (হেসে)। আসলে আমার সৌভাগ্য যে আমি আমার বাবা-মার কাছ থেকে দুটো সংস্কৃতিই চিনতে পেরেছি। যেটা অনেক সময়ই বলা হয় যে প্রবাসীদের সন্তানদের নিজস্ব পরিচয়ের সংকট থাকে। আমার সৌভাগ্য যে আমার মা-বাবার কারণে আমি দুটো সংস্কৃতির মাঝের পথটা আমি চিনে নিয়েছি। আর আমার জন্য যেটা ভালো সেটা আমি বেছে নিতে পেরেছি।
সীমান্ত: দ্বিতীয় প্রজন্মের অনেকের মধ্যে এই পরিচয়ের সংকটটা থাকে। আপনার মনে কি তেমন কখনো দ্বিধা ছিলো?
তিয়াসা: ছিলো হয়তো, কারণ ছোটবেলাতে স্কুলে অনেক সময় ভিন্ন পরিস্থিতির শিকার হয়েছি। আসলে আমি নিজেও কোনদিন মনে করিনি যে আমি মাইগ্র্যান্ট। ক্লাস টেনে ওঠার পর আমার প্রথম এই ধরণের অভিজ্ঞতা হয়। তার আগ পর্যন্ত কেউ যদি আমাকে জিজ্ঞেস করতো তুমি কোত্থেকে এসেছো, আমি বলতাম বন থেকে। আমি কোনদিন ভাবিনি যে আমি অন্যদের চেয়ে আলাদা। তবে আমার সৌভাগ্য যে কোন ঘটনা ঘটলেও আমি বাসাতে এসে সেটা নিয়ে আমার বাবা-মার সঙ্গে কথা বলতে পারতাম, যেটা হয়তো অনেক ছেলে মেয়ের বেলাতে হয় নি।
সীমান্ত: ইন্টেগ্রেশন নিয়ে যে আলোচনা হয় জার্মানিতে সেটা নিয়ে আপনি কী ভাবেন?
তিয়াসা: এটি সত্যি যে অনেকেই জার্মানিতে রয়েছে যারা এই দেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারছে না, ভাষাটাও ঠিকভাবে শিখছে না। এজন্য হয়তো তাদের পারিবারিক ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা রয়েছে। আবার একই সঙ্গে এটাও সত্য যে, এই দেশের সমাজ ব্যবস্থা সবাইকে একইভাবে দেখে না। তবে ইন্টেগ্রেশন খুবই একটা জটিল বিষয়। প্রত্যেক সমাজেরই ভালো মন্দ দুটো দিক আছে। মন্দটা বাদ দিয়ে ভালোটা নিতে হবে। তবে ভাষা শেখাটা এই ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এর মাধ্যমেই তো নিজেকে আরেকজনের কাছে তুলে ধরা যায়।
সীমান্ত: দ্বিতীয় প্রজন্মের যারা রয়েছেন তারা কীভাবে এই দেশে অবদান রাখতে পারে?
তিয়াসা: এর জন্য যে সবাইকে ডাক্তারি পড়তে হবে তা কিন্তু নয়। হ্যা, পড়াশোনাটা ঠিকমত চালিয়ে যাওয়াটা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু যে কোন পেশাতেই মানুষ যদি আন্তরিকতা আর সততার পরিচয় দেয় তাহলেই সমাজের জন্য অবদান রাখা সম্ভব। আমার মতে সকলেরই উচিত নিজ সমাজের জন্য কিছু না কিছু করা।
সীমান্ত: নিজের পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় আপনার কী ধরণের অভিজ্ঞতা হয়?
তিয়াসা: রোগীরা আমাকে দেখে একটু অবাক হয় কারণ ডাক্তার হিসেবে আমার বয়স এখনও অনেক কম। তবে আমার মনে হয়, আমাকে দেখে যদি কারো কোন রকম নেতিবাচক ধারণা জন্মে থাকে তাহলে পরে সেটা ভেঙ্গে গেছে। আর আমার মুখের জার্মান শুনে রোগীরাও বুঝতে পারে যে আমি এই দেশেই জন্মেছি। সত্যি বলতে, আমার পেশাগত কাজের বেলাতে আমি তেমন কোন খারাপ অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হইনি।