Categories
প্রবন্ধ প্রবাস

সংক্ষিপ্ত স্মৃতি? উপনিবেশবাদের স্মরণ

©SP
স্যার্শ পালাজি

যখন আমরা আমাদের ইতিহাস নিয়ে কাজ করবো তখন আমাদের জানতে হবে সামাজিকভাবে ‘‘আমরা’‘ একটা প্রগতিশীল শব্দ। কে এই ‘‘আমরা’‘ এর মধ্যে পড়বে আর পড়বে না – এই প্রশ্নের জবাব নির্ভর করছে কোথায় এবং কাকে এই প্রশ্নটি করা হবে তার ওপর, এবং এটা বদলে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত।

ইতিহাস না ভোলার সংস্কৃতি এবং রাষ্ট্রনীতি যা এই প্রগতিশীল ‘‘আমরা’‘ এর প্রতি সুবিচার করতে চায়, গণমানুষের স্মৃতির উচিত হবে এই বর্তমান ‘‘আমরা’‘ কে সম্পূর্ণরূপে ধারণ করা এবং একে আত্মপরিচয়ের সুযোগ দেওয়া। এটি একটি প্রক্রিয়া এবং রাতারাতি এটা ঘটে না। তবে এটা কাজ করবে তখন যখন ‘‘আমরা’‘ এর মতো স্মৃতির মনিকোঠাও গতিশীল হয়ে উঠবে।

তার মানে ঐতিহাসিক পুনর্বন্টন প্রক্রিয়া, যা প্রায়ই সহিংসভাবে হয়েছিলো এবং অন্যদের গঠিত ‘’আমরা’’ কে এর মূল্য দিতে হয়েছিলো, সেটাকে আমাদের নতুনভাবে জানতে হবে। জনসংখ্যাগত কারণে এই ‘’আমরা’’ যেহেতু বদলে যাচ্ছে তাই স্মৃতির জন্য দৃষ্টিভঙ্গীর বদল প্রয়োজন। এখন কিছু ব্যক্তি এবং ঘটনাকে নতুন করে মূল্যায়ন করা দরকার।

উপনিবেশবাদের পরিপ্রেক্ষিতে স্মৃতি

উপনিবেশবাদের পরিপ্রেক্ষিত মানে হচ্ছে, ইউরোপ এবং অন্যান্য উপনিবেশবাদী শক্তিগুলো যখন সারা বিশ্বকে পদদলিত করছিলো তখন কিছু ভিন্নমতের বাইরে এই ‘‘আমরা’‘ মূলত মনে করছিলো যে, যা হচ্ছে তা ভালোর জন্যই হচ্ছে। সে সময় নানা ব্যক্তির নামে স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি আর রাস্তার নামকরণ করা হচ্ছিলো, যাদের ব্যাপারে মানুষের ভালো ধারণা ছিলো। সেসময় ‘‘আমরা’‘ এর সংজ্ঞা ছিলো খোলাখুলিভাবেই ফেনোটাইপিক, উপনিবেশবাদী বর্ণবাদের ভিত্তিতে, যদিও সেসময় উপনিবেশবাদী ‘‘মাতৃভূমি’‘র মধ্যেই উপনিবেশের কিছু লোক বাস করতো।

এখন অবশ্য ভিন্ন কথা। জার্মানি এখনকার মতো আর কখনই নৃতাত্ত্বিকভাবে এতটা কম সমজাতীয় ছিলো না, এত আলাপ আলোচনা সত্ত্বেও। জার্মান জনগোষ্ঠীর একটি ক্রমবর্ধমান অংশ সাবেক উপনিবেশগুলো থেকে আসা যারা সাম্রাজ্যবাদের শিকার হয়েছিলো এবং এই উপনিবেশবাদের রাষ্ট্রনীতির হাতে নিগৃহিত হয়েছিলো। এই ফেনোটাইপ ‘‘আমরা’কে এখন একটি প্রগতিশীল ‘‘আমরা’এর দিকে যেতে হবে যার মধ্যে অন্য ক্যাটাগরিগুলোও দ্রুত বেড়ে উঠছে, নইলে এই স্মৃতির রাষ্ট্রনীতি জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশকে পাশ কাটিয়ে চলে যাবে এবং তার ফলে যে প্রতিরোধ গড়ে উঠবে সেটা সামাজিক একতাকে হুমকির মধ্যে ফেলবে।

Serge-Palasie©SP

স্যার্শ পালাজি ©SP

উদাহরণ দ্বিতীয় উইলহেল্ম

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কোলন শহরের হোহেনসোলেন সেতুর পাশে দ্বিতীয় উইলহেল্ম এর র্মূর্তি থাকার পক্ষ বিপক্ষ নিয়ে সমাজের নানা অংশে জোরালো তর্ক বিতর্ক হয়ে আসছে। এক পক্ষ বলছে, ”এই স্মৃতিস্তম্ভ সরিয়ে ফেললে কিছুই আসবে যাবে না। ইতিহাস তো আর বদলে ফেলা যাবে না।’‘ কথা সত্য। কিন্তু এর লক্ষ্য তো ইতিহাস মুছে ফেলা নয়, বরং দৃষ্টিভঙ্গীতে বদল আনা যেটা হলো বর্তমান ‘‘আমরা’‘ এর মধ্যে বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে দর কষাকষির ফল।

স্পষ্টতই যেসব লোকদের আজ স্মরণ করা হয় তাদের চরিত্র কখনই একমাত্রিক ছিল না বরং ছিল জটিল এবং কথা ও কাজে পরষ্পরবিরোধী। সেটা দুনিয়ার যেখানেই হোক না কেন। তারা একদিকে এমন কিছু অর্জন করেছেন যেটা সমাজ এবং রাষ্ট্রের জন্য উপকারী ছিলো আবার অন্যদিকে সহিংস, যৌনতাবাদী বা বর্ণবাদী ছিলো। এটা অসম্ভব, একজন মানুষের অবদান এবং সমস্যাযুক্ত দিকগুলোকে নিরপেক্ষভাবে তুলনা করা এবং বলা যে “অমুক ব্যক্তি এতো ভালো করেছেন, তাই স্মৃতিস্তম্ভ কিংবা রাস্তার নামকরণের মাধ্যমে তাকে স্মরণ করা যেতে পারে। অমুক ব্যক্তি এতো খারাপ ছিলেন তাই তাকে স্মরণ করাই যেতে পারে না।” এই সিদ্ধান্ত নেয়ার বিষয়টি নির্ভর করছে সমাজে এই মুহূর্তে “আমরা” কারা তার ওপর। শেষ পর্যন্ত, এই সামাজিক ঐকমত্য বা ভিন্নমতটা উচ্চস্তরের নৈতিক ধারণার চেয়ে বেশি শক্তিশালী।

তবে ব্যতিক্রম তো রয়েছে: যখন এটা স্পষ্ট যে কেউ নির্বিচারে হত্যার নির্দেশ প্রদান করে, তখন প্রভাবশালী সামাজিক “আমরা” এর চেয়ে উচ্চস্তরের নৈতিক ধারণাকেই প্রাধান্য দেওয়া উচিত, যেটা প্রায়শই সংশ্লিষ্ট প্রেক্ষাপট সম্পর্কে অজ্ঞতা থৈকে তৈরি হয়। এর পেছনে দায়ী হচ্ছে রাজনীতি এবং শিক্ষা ক্ষেত্রে কিছু নির্বাচিত ইতিহাসকে বারবার সামনে নিয়ে আসা। দ্বিতীয় উইলহেল্ম উনবিংশ শতকে ব্রেমেনহাফেন শহরে যখন সৈন্যদের সামনে বক্তব্য দিচ্ছিলেন তখন উপনিবেশের বিরুদ্ধে লড়াইরত চীনাদের নির্মূল করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। জার্মান রাইখের অধীনে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগ পর্যন্ত অন্যান্য উপনিবেশবাদীদের মতো জার্মানরাও সেখানে উপস্থিত ছিলো। যে সমাজ মানবাধিকারের কথা জোর গলায় বলে আর মানবাধিকার লংঘনের সমালোচনা করে তাদের জন্য এটা দুই কারণে সমস্যা তৈরি করতে পারে: একজন মানুষের সব মন্দকাজই শুধু “ভালো কাজ” দিয়ে দূর করা যায় না। সমাজে “আমরা” এর মধ্যে পরিবর্তনের কারণে এই ঘটনার গ্রহণযোগ্যতা দিন দিন কমছে। পাশাপাশি এই ধরণের স্মৃতির রাজনীতি বহির্বিশ্বে আমাদের বিশ্বাসযোগ্যতার ক্ষতি করছে। আজ আমরা ঠিকই চীন সহ সারা বিশ্বের মানবাধিকার লংঘন নিয়ে কথা বলছি। একই সঙ্গে আমরা এমন একজন মানুষকে সম্মান দেখাচ্ছি যার হত্যাযজ্ঞের নীতি/নির্দেশ হাজার হাজার মানুষের জীবন কেড়ে নিয়েছিল। এখানে আমাদের স্মৃতি এত সংক্ষিপ্ত হওয়া উচিত নয়।

কারণ এই ডাবল স্ট্যান্ডার্ড, যার অনেকটা অবচেতনভাবে, হয়তো “আমাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার” করা হতে পারে। কীভাবে আমরা মানবাধিকার রক্ষার আহ্বান জানাবো যখন আমরা একই সময়ে এই মানবাধিকার লংঘনকারীদের প্রকাশ্যেই স্মরণ করবো? যার মনের মধ্যে বিবেকের এই তাড়না রয়েছে, সে যখন হোহেনসোলেন সেতুর পাশ দিয়ে যাবে, তখন সে কেবল একটা ঘোড়া আর তার সওয়ারীকেই দেখবে না।

উনবিংশ শতকে সর্বোচ্চ রাজনৈতিক পর্যায় থেকে যে নির্মূল আহ্বানের সূচনা করা হয় তাতে সেসময়কার জার্মানদের হাতে ওভাহেরেও এবং নামা (বর্তমান নামিবিয়া) এলাকায় গণহত্যার ঘটনাও অন্তর্ভূক্ত ছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরুর কারণটাও সেসময়কার জার্মান কাইজারের এই মনোভাবের মাধ্যমে ভালোভাবে বোঝা যায়। তবে এক্ষেত্রে জার্মানদের প্রতিপক্ষের হাতে ছিল আধুনিক অস্ত্র যা উপনিবেশগুলোর কাছে ছিল না, আর এর ফলে জার্মানদের মধ্যে ব্যাপক প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। উইলহেল্ম এর সময়ে বহু মানুষের প্রাণহানি হয়েছিল। নতুন “আমরা” কোন ধরণের ভেদাভেদ না করে তাদের সকলকে স্মরণ করছে। প্রকৃত ঘটনা হলো, যুদ্ধে হেরে যাওয়ার পর সাবেক কাইজার নাৎসি আমলে আবারও ক্ষমতায় বসার জন্য হিসেব কষছিলেন, যেটা আসলে প্রমাণ করে স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য তার কোন নৈতিক সীমারেখা ছিল না।

এটা শুধু একটা উল্লেখযোগ্য উদাহরণ মাত্র। অন্য স্মৃতিস্তম্ভগুলো নিয়েও একই রকমের সমালোচনা করা যায়। কিন্তু এসব কীভাবে মোকাবেলা করা হবে তা নিয়ে কোন নীল নকশা নেই। সমাজের অংশীদারদের সকলের সঙ্গে এসব নিয়ে সংলাপ করতে হবে। এছাড়া প্রয়োজন হলে এর জন্য নতুন উপায় খুঁজে বের করতে হবে। কারো জন্য একটি কিউআর কোড সম্বলিত ঐতিহাসিক শ্রেণীবিন্যাসই যথেষ্ট, কারো জন্য নয়। তার অর্থ এই নয় যে, আমাদের কয়েক বছর পরপর স্মৃতিস্তম্ভ বদলাতে হবে। তার অর্থ হচ্ছে, একবার উন্মোচন করা হয়েছে বলে কোন স্মৃতিস্তম্ভ চিরস্থায়ী, এই দাবী করা যাবে না।