Categories
প্রবন্ধ প্রবাস

নিশিরাতে কর্মযজ্ঞের এপিঠ ওপিঠ

ডঃ হোসাইন আব্দুল হাই

সোমবার, মধ্যরাত। পুরো শহর ঘুমে আচ্ছন্ন। এখানে-সেখানে কিছু ভবনে তবুও ঝলমল করছে আলোর ঝালর। ক্লান্তি-শ্রান্তি তাদের খুব একটা কাবু করতে পারে না। এদের অধিকাংশই সাদা পোশাক পরিহিত। রাত কাটে রোগীদের সেবায়। যেমনটি দেখা যাচ্ছে জাঙ্কট মারিয়েন হাসপাতালে, যেটি বন নগরীর পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত।

নগরীর বড় ঘড়িতে এখন পৌনে একটা। লাল বাতি জ্বেলে খুব দ্রুত বেগে একটি অ্যাম্বুলেন্স ছুটে এসে হাসপাতালের প্রধান ফটকে দাঁড়ায়। অ্যাম্বুলেন্সে একজন আহত ব্যক্তি শুয়ে কাতরাচ্ছে। কেসেনিশের কাছে হাইওয়েতে দুর্ঘটনার শিকার তার গাড়ি। আহত ব্যক্তিকে দ্রুত অ্যাম্বুলেন্স থেকে জরুরি কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়। ডাক্তার এবং নার্সরা অবিলম্বে রোগীকে যত্নের সাথে পরীক্ষা করা শুরু করে। রাতভর জরুরি চিকিৎসায় ব্যস্ত চিকিৎসক ও নার্সরা। অনেক সময় গর্ভবতী মহিলারাও জরুরী অবস্থায় মাঝরাতে হাসপাতালে ছুটে আসেন। তাদের তৎক্ষণাৎ ধাত্রী দ্বারা পরিচর্যা করা হয়।

দিনরাতের পালাক্রম

জার্মান-পাকিস্তানি চিকিৎসক ডাঃ জান্নাত চৌধুরী (ছদ্মনাম) বনের জাঙ্কট মারিয়েন হাসপাতালে একজন স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ। তিনি এবং তাঁর সহকর্মীরা রাতে পালা করে কাজ করেন। নাইট শিফট শুরু হয় রাত ৮টায়। সবসময় সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় ব্যাড গোডেসবার্গের বাড়ি থেকে গাড়ি নিয়ে রওয়ানা করেন। তারপর সারারাত দায়িত্ব পালন। পরদিন সকাল সাতটা বা আটটার দিকে নাইট শিফট শেষ হয়। পুরোপুরি ক্লান্ত। লাল চোখ নিয়ে বাড়ি ফিরে বিছানায় যেতেই যেন রাজ্যের ঘুম এসে জড়িয়ে ধরে।

প্রতি রাতে চিকিৎসকদের ডিউটি থাকে না। তবে তারা যখন রাতে কাজ করে তখন তাদের জন্য রাত হয়ে যায় দিন এবং পরের দিন হয়ে যায় রাত। ফলে পরিবারের সদস্যরা এবং বন্ধু-বান্ধবরা রাত এবং দিন উভয় বেলাতেই রাতের কর্মীদের খুব মিস করে থাকে।

ডিউটিতে থাকলে ডাঃ চৌধুরীর ভোর ৩টার দিকে খাওয়া-দাওয়া করার কিছুটা সময় মেলে। নাইট ডিউটিতে থাকা সহকর্মীরা প্রায় সবসময় সন্ধ্যার দিকেই একসাথে খাবারের অর্ডার দেয়। যাহোক, কখনও কখনও তাদের খাওয়ার সময় থাকে না, তাই খাবার ঠান্ডা হয়ে যায়। কিন্তু আজ ডাঃ চৌধুরীর বিরতি নেওয়ার ফুরসত মিলেছে। বিরতির সময় তিনি জানালেন: ডিউটির সময় এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে ভিন্ন ভিন্ন হয়। নাইট শিফট মানে জরুরী বিভাগের রোগী এবং হাসপাতালে ভর্তি থাকা রোগীদের যত্ন নেওয়ার জন্য সারা রাত হাসপাতালে কর্মব্যস্ত থাকা।

হাসপাতালের কর্মীরা কি রাতের শিফটে মাঝে মাঝে একটু ঘুমাতে পারেন নাকি একেবারেই ঘুমাতে পারেন না? এমন প্রশ্নের উত্তরে ডাঃ চৌধুরী বললেন, “এটা নির্ভর করে কতটা ব্যস্ততা রয়েছে তার ওপর। কখনো কখনো দুই থেকে তিন ঘণ্টা বিশ্রাম নিতে পারেন। বেশিরভাগ সময়, অবশ্য, ঘুমানোর সুযোগ হয় না।”

রাতে রোগীর চাপ কেমন থাকে – জানতে চাইলে তিনি বলেন, “এটা একেক রাতে একেক রকম। যেমন, আমরা ডেলিভারি রুমে এবং আমাদের জরুরী বিভাগের রোগীদের সেবা প্রদান করি। কখনও কখনও আমাদের এক রাতে আটটি সন্তানের জন্ম হয়েছে। আবার কখনও কখনও কম। আগে থেকে এটা কোনভাবেই বোঝার উপায় নেই। জরুরী বিভাগে খুব অল্প সময়েই অনেক রোগীতে ভর্তি হয়ে যেতে পারে। তবে মাঝে মাঝে খুব কম রোগী থাকে।“

চ্যালেঞ্জিং তবে আকর্ষণীয়

রাতের ডিউটি প্রায়শই খুব ভোরে শেষ হয়। তারপর বাসায় গিয়ে ঘুম। বেশিরভাগ সময়ই, খুব সহজে ঘুম আসে না। আবার কখনও কেনাকাটা থাকে, ব্যাংকে যেতে হয় বা পরিবারের সদস্যদের যত্ন করতে হয়। সেক্ষেত্রে ঘুমানোর সুযোগ হয় একেবারে দুপুরে কিংবা বিকেল বেলা। সেক্ষেত্রে স্বাভাবিক দিন-রাতের ছন্দে ফিরে আসতে বেশ সময় লাগে। “সারা রাত জেগে থাকা এবং কাজ করা অবশ্যই ক্লান্তিকর। কিন্তু এটা আমাদের দায়িত্বের অংশ। রাতে কাজ করতেও মজা লাগে। জরুরী পরিস্থিতি মোকাবেলা করা প্রায়শই একটি চ্যালেঞ্জ এবং তাই আকর্ষণীয়ও বটে।”

অকল্পনীয় এবং বিরক্তিকর

কিছু লোক রাতে কাজ করার কথা কল্পনাও করতে পারে না। তারা নাইট শিফটে খুব ভয় পায়। রাতে কাজ করতে হলে অসুস্থ হয়ে পড়বে বলে মনে করে তারা। তারা মনে করে – রাত শুধু ঘুমানোর জন্য। যদি তাদের রাতে ঘুমাতে দেওয়া না হয় তবে তারা তাদের স্বাভাবিক ছন্দ হারিয়ে ফেলে। যেমন জার্মান-তুর্কি আইটি বিশেষজ্ঞ মামেট তুগলাক (ছদ্মনাম) বলেছেন: “আমি কখনই নাইট শিফটে কাজ করিনি। আমি মনে করি এটি খুব কঠিন, এটি অবশ্যই কঠিন। সারা রাত কাজ করা এবং দিনের বেলা ঘুমানো – এটি অচিন্তনীয়। দিনের বেলা অনেক কিছু ঘটে। আপনি শান্তিতে ঘুমাতেই পারবেন না। আমি মনে করি না, কেউ রাতে স্বেচ্ছায় কাজ করতে চাইবে। কেউ কেউ অবশ্য এটা করে, কারণ তাদের করতে হয়।”

যদি তিনি এমন একটি চাকুরীর অফার পান, যাতে তাকে রাতে কাজ করতে হয়, তবে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করবেন। তাঁর ভাষায়, “আমি অল্প কিছুদিনের জন্য নাইট শিফট করতে পারি, কিন্তু মাসের পর মাস রাতে কাজ করার কথা কল্পনাও করতে পারি না। যদি আমাকে রাতের বেলা কাজ করতে হয় এবং আমার স্ত্রী দিনে কাজ করে, তাহলে তো পরিবার এবং আত্মীয়-স্বজনের সাথে কোন সম্পর্কই থাকবে না। আমরা কেবল অল্প সময়ের জন্য একে অপরের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ করতে পারব এবং এটি পুরো পরিবারের জন্যই কষ্টকর হয়ে দাঁড়াবে।”

নাইট শিফট যখন উপভোগ্য

জার্মান-বাংলাদেশি চিকিৎসক ডা. শাহিনা বিশ্বাস (ছদ্মনাম) তাঁর একটি নাইট শিফট-এর মজার গল্প শোনালেন। তিনি খুব ভালো গান গাইতে পারেন। বাংলাদেশের একটি হাসপাতালে তাঁর নাইট শিফটের সময়, যখন মাঝে মাঝে রোগীর সংখ্যা কম থাকে, অন্যান্য সহকর্মীরা তার কামরায় এসে জড়ো হতেন এবং তাঁকে গান গাওয়ার জন্য বায়না ধরতেন। একবার তিনি রাতের বেলা সহকর্মীদের সাথে নিয়ে নিজের কক্ষে গান গাইতে আছেন, হঠাৎ সেখানে এক রগী প্রবেশ করে। রোগীতো প্রথমে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে ভাবছে – সে ভুল ঘরে প্রবেশ করেছে। তখন ডাঃ বিশ্বাস এবং তাঁর সহকর্মীরা তাকে আশ্বস্ত করেন, যে তিনি সঠিক জায়গাতেই এসেছেন এবং তৎক্ষণাৎ তাঁরা তাকে প্রয়োজনীয় সেবা দেন এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন।

বর্ণালী অভিজ্ঞতায় ভরা

এভাবেই চলে নিশিরাতের কর্মযজ্ঞ। এর রয়েছে নানা দিক ও প্রেক্ষিত। এটা কিছু মানুষকে আনন্দিত করে, আবার কাউকে করে আতঙ্কিত। কেউ কেউ নাইট শিফটে ভয় পায়। আবার কেউ কেউ বেশি বেশি রাতের শিফটে কাজ করতে চায়, কারণ রাতের কাজে মজুরি প্রিমিয়াম মেলে। অবশ্য, কিছু লোকের বক্তব্য, টাকাই তো সবকিছু নয়। বরং তাদের কাছে পেশাগত দায়িত্ব অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। যেমন, চিকিৎসক, সেবিকা, অগ্নিনির্বাপক, পুলিশ এবং সেনাবাহিনীর সদস্যরা যত চ্যালেঞ্জই আসুক না কেন, সব পরিস্থিতিতেই মানুষকে সাহায্য করার জন্য দিন-রাত কাজে নিযুক্ত থাকেন।