বিকাশ চৌধুরী বড়ুয়া
সুকান্তের কবিতা দিয়ে শুরু করা যাক। বেচারা মুরগী। খাবারের আশায় প্রতিদিন খাবার টেবিলের পাশে ঘুরঘুর করে। স্বপ্ন দেখে সেও একদিন টেবিলে উঠবে। অবশেষে একদিন ঠিকই টেবিলে উঠে এলো। তবে খাবার খেতে নয়, খাবার হিসাবে। এই মুরগীর সাথে প্রবাসীদের তুলনা করেছিলাম এক ঘরোয়া আড্ডায়। উপস্থিত কেউ কেউ মুরগীর সাথে মনুষ্য প্রাণীর তুলনার বিষয়টা পছন্দ করেননি। মৃদু প্রতিবাদ জানিয়ে তারা প্রশ্ন রাখেন, মুরগীর সাথে মানুষের বুঝি তুলনা চলে? হয়তো চলে না, কিন্তু যেটি চলে বা প্রচলিত তা হলো, ছোট আত্মার লোকদের আমরা ইংরেজীতে বলি, চিকেন হার্টেড (chicken hearted ) অর্থাৎ ক্ষুদ্র আত্মার অধিকারী। তখন কিন্তু ঠিকই মুরগীর উপমা টানা হয়। এই ক্ষুদ্র আত্মা বা চিকেন হার্টেড লোকের তো অভাব বেই এই ইহ জগতে। আমাদের আশপাশেই তো ঘুরঘুর করে, আমাদের মধ্যেও কি চিকেন হার্টেড’ লোকের কমতি আছে? মুরগীর সাথে মানুষের আরো কত মিল, ওর দুটি পা, আমাদেরও। ভোর হলেই জাগতিক নিয়মে তার ঘুম থেকে জেগে উঠা, আমাদেরও। সজ্জনদের সেই ঘরোয়া আড্ডায় সেদিন এই কথাটাই বলতে চেয়েছিলাম যে , আমাদের অর্থাৎ প্রবাসীদের দশা ওই বেচারা মুরগীর চাইতে খুব একটা ভিন্ন নয়। দু-একটা ব্যতিক্রম ছাড়া আমরা যারা ধীর্ঘ দিন ধরে প্রবাসে আছি, স্বপ্ন দেখি, মনে মনে অংক কষি একটু থিতু হলে পর, সন্তানেরা একটু বড় হয়ে যাক, তারপর ফিরে যাওয়া যাবে যেখান থেকে আসা হয়েছে, সেই শেঁকড়ে। প্রবাসী কাঁদে তার শেকড়ে ফিরে যাবার জন্যে যেমন কাঁদে শেঁকড় জলকণার জন্যে। ভাবে ফিরে গিয়ে ফেলে আসা দেশের মাটির সোঁদা গন্ধ নেবে প্রাণ ভরে। কারো কারো সে স্বপ্ন সত্যি হয়, অনেকের স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যায়, আশা আর পূরণ হয়না। এদের অনেকেই আজ, কাল করে করে একটা সময় দেশে ফিরে যায়। ফিরে যায় বটে, তবে লাশ হয়ে। ঠিক টেবিলের নীচে চারপাশে ঘুরঘুর করা মুরগীটির মত।
সুনীল বড়ুয়ার কাহিনী দিয়েই শুরু করা যাক। সম্পর্কে তিনি আমার পরম আত্মীয়। হল্যান্ডে প্রথম তিন বাংলাদেশীর একজন। প্রায় ৫০ বছর আগে উত্তর সাগর পাড়ের এই দেশটিতে এসেছিলেন ছোটখাটো গড়নের, অতিথিবৎসল সবার পরিচিত ও শ্রদ্ধাভাজন সুনীলদা। দেশে রেখে এসেছিলেন তার পরিবার- স্ত্রী, তিন সন্তান ও এক মাত্র কন্যা। তার আসার কিছুদিন পর নিয়ে এলেন তার বড় সন্তানকে। মেধাবী সেই সন্তান কয়েক বছরের মধ্যে নিজেকে এদেশের সাথে খাপ খাইয়ে নিলো, বেরিয়ে এলো ইঞ্জিনিয়ার হয়ে। সেই ছেলে বাবাকে তাগাদা দিতে থাকে গ্রামে ফেলে আসা মা, বোন, ভাইদের নিয়ে আসতে। বাবা চাইলেও মা ইউরোপ আসতে নারাজ। তিনি কিছুতেই তার গোয়াল-গরু, পুকুরের মাছ, ক্ষেত ফেলে এই বিদেশ বিভুঁইয়ে আসবেন না। তারপরও অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে তাকে রাজী করানো হলো। এক সময় মা, মেয়ে, দেশে রেখে আসা দুই ছেলে দুরুদুরু বক্ষে এসে পৌছালো ইউরোপের এই দেশটিতে। জীবনের প্রায় গোটা সময়টা ইউরোপে কাটালেও সবার পরিচিত এই বড়ুয়াদা দেশকে মুহূর্তের জন্যেও দূরে রাখতে পারেননি। কয়েক বছরের মাথায় দেশে যেতেন বেড়াতে, গ্রামের রাস্তা ধরে এর বাড়ী ওর বাড়ী গিযে নিকটজন, পরিচিতিদের খোঁজ খবর নিতেন, আড্ডা দিতেন, সন্ধ্যে হলে গ্রামের মন্দিরের দিকে হেঁটে যেতেন। তাকে ঘিরে গ্রামের বড়রা অতি আগ্রহে তার কথা শুনতেন। অল্প বয়েসী ছেলেরা একটু দূরত্বে তার দিকে তাকিয়ে থাকতো, তার কথা শুনতো। সে সময় ওই গ্রামে তিনিই ছিলেন একমাত্র প্রবাসী। এখন তো ওই গ্রামের প্রায় প্রতিটি বাড়ী থেকে এক বা একাধিক সদস্য বিদেশে রয়েছে। এই বড়ুয়াদা সব সময় বলতেন, ‘একদিন দেশে ফিরে যাব’। দিন যায়, মাস যায়, বছর গড়ায়। বড় ছেলে ইঞ্জিনিয়ার হয়ে যোগ দেয় হল্যান্ডের ফিলিপস কোম্পানীতে। ফেলে আসা গ্রামের প্রথম ইঞ্জিনিয়ার। বড়ুয়াদা গর্ব বোধ করেন ছেলের সাফল্যে। মুখে কিছু বলেননা, কখনো প্রকাশ করেননি। এমনটাই তার স্বভাব, প্রচার-বিমুখ ছিলেন তিনি। নিজেকে নিজের মাঝে গুটিয়ে রাখতেন, যদিও বা তার মত অতিথিবাৎসল ব্যক্তি হল্যান্ডে আর দ্বিতীয়টি ছিলনা। হল্যান্ডের অভিজাত এলাকা, বুরখামেইষ্টার পাতাইন লেনে তার চার বেড রুমের ফ্ল্যাটে আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার বোন শেখ রেহানা সহ বাংলাদেশের সরকারি-বেসরকারী অনেক উচ্চপদস্থ ব্যক্তি তার আতিথ্য গ্রহণ করেছেন। বড় ছেলের পাশাপাশি বাকী দুই ছেলে ও মেয়ে এক সময় তাদের লেখাপড়া শেষ করলো, চাকরী নিলো। ছেলে মেয়েরা যখন পড়াশুনা করছিল তখন তখন বড়ুয়া দাকে বলতে শোনা যেত, ”ছেলে মেয়েরা নিজের পায়ে দাঁড়াক, তারপর সস্ত্রীক দেশে ফিরে যাব”। এক সময় সবার লেখাপড়া শেষ, তারা চাকরী নিলো। বন্ধুরা বলে, ‘এবার তো তোমার দেশে যাবার সময় হলো’। মুখে হাসি মেলে বলেন, ‘তাদের বিয়ে টিয়ে দেই, তারপর যাওয়া যাবে’ । একটা সময় ছেলেদের বিয়ে দিলেন নিজের পছন্দে, দেশে গিয়ে। একমাত্র কন্যা বিয়ে করলো তার নিজের পছন্দের ছেলেকে। ছেলেটি মন্দ নয়, লেখাপড়া মোটামুটি। মা-বাবার পরিচিত এবং ছেলে সম্পর্কে তাদের ধারণাও খুব একটা মন্দ নয়। সেই জামাইও এক সময় হল্যান্ড এলো। নিজের পায়ে দাঁড়ালো অল্প সময়ে। ছেলে মেয়েরা ইতিমধ্যে যার যার বাসায় চলে গেল, আলাদা থাকে। সপ্তাহের প্রায় প্রতিটি দিন সন্ধ্যেয় তার ফ্ল্যাটে হই চই, মেলার মতো, আড্ডা, খাওয়া-দাওয়া। ছেলে মেয়ে তাদের স্বামী স্ত্রী সবাই জড়ো হয়। রাতভর চলে হই চই। সে সময় হল্যান্ডে এই পরিবারটি ছিল একমাত্র পরিপূর্ণ, যেখানে সবার এক সাথে একই দেশে বসবাস। বাকী হাতে গোনা বাংলাদেশী প্রবাসীদের বেশীর ভাগই তরুণ, প্রায় অনেকেই তখন বিয়ে করেনি, কেউ বিয়ে করে বউ নিয়ে এসেছে, কেউবা এদেশে থাকার অনুমতি লাভের আশায় ‘কন্ট্রাক্ট ম্যারেজ’ করেছে, কেউবা প্রথমে এদেশী মেয়ে বিয়ে করে, ‘কাগজ’ হাতে পাবার পর দেশী মেয়ের সন্ধানে দেশে গেছে এবং বিয়ে করে নিয়ে এসেছে, কেউবা নিজেকে ‘রোহিঙ্গা’ পরিচয় দিয়ে থাকার অনুমতি চেয়ে আবেদন করেছে। জীবন ও জীবিকার জন্যে রীতিমত সংগ্রাম করছে। সেই অর্থে বড়ুয়াদার সন্তানেরা সৌভাগ্যবান। তাদের জীবন সংগ্রাম বলতে যা বুঝায় তেমন কোন পর্যায় পাড়ি দিতে হয়নি। যাই হোক, বিয়ের পর স্বাভাবিক নিয়মে শাখা প্রশাখা গজাতে লাগলো। নাতি-নাতনীতে ভরে গেল বড়ুয়াদার সংসার। ততদিনে তিনি পেনশনে চলে গেছেন। তার এবং তার স্ত্রীর দিন কাটে নাতি-নাতনিদের ঘিরে। ছুটির দিনে, ছুটির বাইরে তারা আসে, গোটা বাড়িটিকে হই চই করে মাথায় তোলে। প্রতিবেশীদের কেউ কেউ মৃদু আপত্তি জানায়। সময় এগিয়ে চলে। পরিচিতজনেরা বলে, এখন তো তোমার সব আশা পূরণ হয়েছে, ছেলে-মেয়ে বড় হয়েছে , বিয়ে-থা দিয়েছ, এবার তো দেশে যাচ্ছ তাহলে?’ নাতী নাতনীদের দেখিয়ে তিনি বলেন, ‘এদের ফেলে দেশে যাই কী করে? মায়ার জালে যে আটকে গেছি।’ বড়ুয়া দার আর দেশে যাওয়া হয়না। একটা সময় তাকে আশ্রয় নিতে হয় বৃদ্ধ কিন্তু চলাচল করতে সক্ষম তেমন লোকদের জন্যে নির্মিত ওল্ড হোমে, যেখানে বাড়ীর কাজের জন্যে আসে নিয়মিত কাজের লোক। দিন দিন তার শরীর খারাপ হতে থাকে। দেশে যাবার জন্যে তিনি মরীয়া হয়ে উঠেন। কিন্তু ডাক্তার বাঁধ সাধে, পরামর্শ দেন, এই শরীরে এত দীর্ঘ জার্নির ধকল শরীর সইবে না। তার শরীর আরো খারাপ হতে থাকে, দেশে ফিরে যাবার তার যে তীব্র আকাংখা এতদিন ছিল, জানিনে জীবনের শেষ সময়টুকুতে সেই আকাংখার বেগ তেমন প্রবল ছিল কিনা। জিজ্ঞেস করিনি। একটা সময় তিনি ফিরে গেলেন, তবে লাশ হয়ে, বাক্সবন্দী হয়ে।