চার দশক ধরে জার্মানিতে বাস করছেন বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত চিত্রশিল্পী মারুফ আহমেদ। স্ত্রী সন্তান নিয়ে এই দেশেই থিতু হয়েছেন অনেক বছর হলো। জার্মানির আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ডিডাব্লিউতে কাজ করেছেন দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে। প্রথম বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত শিল্পী হিসেবে জার্মানিকে প্রতিনিধিত্ব করেছেন চীনের চেংদু শহরে। সীমান্ত ম্যাগাজিনের সঙ্গে কথোপকথনে উঠে এসেছে তার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা এবং ইন্টেগ্রেশন প্রসঙ্গ।
সীমান্ত: চিত্রশিল্পীর পাশাপাশি আপনার আরও দুটি পরিচয় আছে। আপনি বাংলাদেশে চলচ্চিত্র এবং জার্মানিতে ডয়চে ভেলে রেডিওর সঙ্গেও জড়িত ছিলেন।
মারুফ আহমেদ: আসলে অনেক কিছুর সঙ্গেই জড়িত ছিলাম। তবে শেষ পর্যন্ত শিল্পকলার সঙ্গেই থেকে গেছি। চরিত্রাভিনেতা ইনাম আহমেদের সন্তান হওয়ার সুবাদে পাঁচ বছর বয়সেই রেডিওতে শিশু অভিনেতা হিসেবে আমার হাতেখড়ি। বাবার কারণেই আমার আর্ট কলেজে যাওয়া হয়েছিল। তখনও বাংলাদেশ স্বাধীন হয়নি। সেসময় শিল্পকে পেশা হিসেবে বেছে নেওয়াটা খুব কঠিন ছিলো। চাকরি হবে না, বউ পাবে না এমন কত কথা শুনতে হতো তখন! তবে বাবা নিজে শিল্পী হওয়ার কারণেই আর্টের সঙ্গে জড়িত হতে পেরেছিলাম। এরমধ্যে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয় এবং আমরা অনেকেই এর সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। যুক্ত থাকার অর্থ এই নয় যে যারা বন্দুক হাতে নিয়েছিল শুধু তারাই জড়িত ছিল। দেশের ভেতরে থেকেও অনেকে মুক্তিযুদ্ধে অনেক বেশি অবদান রেখেছিল। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৩ সালে আবার তোরা মানুষ হ নামে ছবিটিতে অভিনয় করি। ছবিটি বার্লিনের একটি চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কার পায়। তারপর পড়াশোনা শেষে ব্রিটিশ হাইকমিশনে দোভাষীর চাকরিও করেছি। অন্যদিকে রেডিওতে তখন নিউজ পড়তাম। সে সুবাদে জার্মানির সাংবাদিকদের সঙ্গে আমার জানাশোনার হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় সারা বিশ্বের অনেক সাংবাদিক ঢাকায় অবস্থান করছিলো। আমি জেডডিএফ এর সংবাদদাতা আনসেল্ম হায়ারের সঙ্গে তখন কাজ করেছিলাম। তাদের একটা সংগঠন ছিলো আন্তর্জাতিক লেখকদের জন্য, তারা একবার বৃত্তি দিয়েছিলো শুধু শিল্পীদের জন্য। সেটা আমি পেয়েছিলাম। তারপর জার্মানিতে আসার পর ডিএএডির বৃত্তি নিয়ে শিল্পকলার ওপর আমি মাস্টার্স এবং পিএইচডি করি। মূলত তখন থেকেই শিল্পকলার প্রতি আমার ভীষণ নেশা তৈরি হয়।
সীমান্ত: আপনার উল্লেখযোগ্য কয়েকটি প্রদর্শণীর কথা বলুন।
মারুফ আহমেদ: জার্মানিতে পড়ার সময়ই আমার ছবি বিক্রি শুরু হয়। এতে বৃত্তির পাশাপাশি কিছুটা বাড়তি পয়সাও আসতো। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করার পর আমি জার্মান কর্তৃপক্ষকে বললাম, দেখো, ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হলে বাংলাদেশে কিছু করতে পারতাম। কিন্তু শিল্পী হিসেবে এই দেশে আমি বেশি অবদান রাখতে পারবো। এরপর জার্মান শিল্পীদের সংগঠন আমাকে সদস্য করে নেয়।
আমার প্রথম প্রদর্শণী হয় অ্যারবাখ/ওডেনভাল্ড স্টাডহালের হিস্টোরিক্যাল টাউনহলে। তারপর বায়ার লেভারকুজেনের মিউজিয়ামে একটি প্রদর্শণী হয় যেখানে পিকাসোর গ্রাফিক্স শিল্পকর্মের প্রদর্শনী হয়েছিলো। এরপরই আমার নাম ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সবচেয়ে নামকরা গ্যালারি হলো বাওকুন্সট গ্যালারি। সেখানেও আমার প্রদর্শণী হয়েছে। এছাড়া প্যারিস সহ ফ্রান্স এবং ব্রিটেনের কয়েকটি শহরের গ্যালারিতেও আমার ছবি জায়গা পেয়েছে। তবে শিল্পী হিসেবে আমার সবচেয়ে বড় সাফল্য হলো আমাকে যখন বন শহর কর্তৃপক্ষ তাদের শিল্পী প্রতিনিধি হিসেবে চীনের চেংদু শহরে পাঠায়।