Categories
ব্লগ লেখালেখি

জুলাই বিপ্লব: হাজার কিলোমিটার দূর থেকে এক বোনের সাক্ষ্য


তামান্না ইয়াসমিন

গত বছরের জুলাইয়ে বাংলাদেশে শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে গণআন্দোলন যখন ফুঁসে উঠলো, আমি তখন জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্টে—দেশ থেকে প্রায় আট হাজার কিলোমিটার দূরে। শারীরিকভাবে দূরে থাকলেও, হৃদয়ে আমি প্রতিটি মুহূর্তে দেশের সঙ্গে ছিলাম। কোটা সংস্কার থেকে শুরু হয়ে এই আন্দোলন দ্রুতই রুপ নেয় দীর্ঘদিনের ফ্যাসিস্ট শাসনের বিরুদ্ধে এক গণবিস্ফোরণে। দূরদেশে বসে আমি শুধু খবর পড়িনি—আমি অপেক্ষায় থাকতাম ছোট ভাইয়ের ফোনের, শুনতাম মায়ের আতঙ্কিত কণ্ঠ, আর ঘুমহীন রাতগুলোয় চোখের সামনে ভেসে উঠতো দেশের রক্তাক্ত বাস্তবতা।

জুলাইয়ের একদিন আমার ছোট ভাই সেমিস্টার বিরতির জন্য সাভার থেকে বাসায় ফিরছিল। ফোনে কথা বলার সময় আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম, আশেপাশে এমন কিসের শব্দ হচ্ছে? সে বলল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র ভাইয়েরা কোটা প্রথার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছে।

পরদিন ওর সঙ্গে আবার কথা হয়। চারপাশে সবকিছু স্বাভাবিক মনে হলেও, পরিস্থিতি ক্রমশই খারাপের দিকে যাচ্ছিল—সাবেক ফ্যাসিস্ট সরকারের দমননীতির কারণে। আমি ২০১৬ সাল থেকে জার্মানিতে থাকি, পরিবার থেকে অনেক দূরে। দেশের এমন অস্থির পরিস্থিতি আমার মানসিক স্বাস্থ্যের উপর গভীর প্রভাব ফেলছিল। কাজেও মন বসছিল না।

১৭ই জুলাই জানতে পারলাম, আমার ভাই ও তার বন্ধুরা নিজ নিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রতিবাদে অংশ নেবে। বাবা-মা খুব উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। বারবার ফোন করে আমাকে বলেন, যেন আমি ভাইকে বুঝিয়ে বাসায় থাকতে বলি। কিন্তু আমার বিবেক যে তাতে সায় দিল না, ভাইকে শুধু বললাম—‘প্রতিদিনের মতো আজও সাবধানে থেকো।’ আমি কী করে তাকে না যেতে বলি? যেখানে তার আগের দিন ১৬ই জুলাই রংপুরে আবু সাঈদকে পুলিশ প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করে?

©TY

সেই রাতটা আমি ঘুমাতে পারিনি। ভোর ৪টায় মা ফোন করলেন—ভাই তখনও ঘুমিয়ে, আর তিনি পাশে বসে পাহারা দিচ্ছেন। কিছুটা স্বস্তি নিয়ে ঘুমোতে গেলাম। কিন্তু সকাল সোয়া ৬টায় আবার ফোন বেজে উঠলো, মা বললেন—ভাইকে কোথাও খুঁজে পাচ্ছেন না। কাউকে না বলে বাসা থেকে ও বের হয়ে গেছে।

ওর মোবাইলে ফোন করলাম অন্তত শতবার। সাঈদের মৃত্যুর খবর আর তার পরের সহিংস বিক্ষোভ মনের মধ্যে ঝড় তুলছিল। ৫ই আগস্ট পর্যন্ত আমি ঠিক মতো খেতে পারিনি, ঘুমাতে পারিনি, শুধু অজানা আশঙ্কায় কেঁপে উঠতাম। শুরুতে ভাই মেসেঞ্জারে লিখে জানাতো সে ভালো আছে, পরে ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়ার পর শুধু মোবাইলে টেক্সট মেসেজ পাঠাতো। ওই রাতে (১৮ই জুলাই) সে বন্ধুদের সাথে বাইরে ছিল নিরাপত্তার জন্য। সারা দেশে ইন্টারনেট জ্যামারের কারণে যোগাযোগ প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। শেষমেশ জানতে পারি, সকালে সে নিরাপদে বাড়ি ফেরে। এরপর প্রতিদিন ভাই ও তার বন্ধুরা মিছিলে যেত। প্রতিবার যাওয়ার আগে তারা মোবাইলের সব মেসেজ মুছে ফেলত, যাতে নজরদারির শিকার না হয়।

এই দূরত্ব সহ্য করা কঠিন হয়ে পড়েছিল। জুলাই মাসে একদিন আমি মাকে বলে ফেলি, আমি বাংলাদেশে ফিরতে চাই, ভাইয়ের সাথে যোগ দিতে চাই। আমার কথা শুনে মা কেঁদে বললেন, “তোমার ভাইয়ের কথা ভেবে প্রতিদিন আমি আতঙ্কে থাকি, তুমি এলে আমি দুই সন্তানের দুশ্চিন্তা নিয়ে কীভাবে বাঁচব?”

প্রতিদিন আমি স্ক্রল করতাম—টেলিভিশন, ফেসবুক, আন্তর্জাতিক ওয়েবসাইট, ব্লগ—যেখানে থেকে একটু নিশ্চিত খবর পাওয়া যায়। আমি তখনই রান্না করে খেতাম, যখন জানতাম ভাই বাসায় ফিরেছে, ঘুমিয়ে আছে বা অন্তত বেঁচে আছে। আমি জার্মানির বনে ও ফ্রাঙ্কফুর্টে বাংলাদেশি কমিউনিটির আয়োজিত প্রতিবাদে অংশ নেই। সেখানে আমি নিজের মতো আরও অনেককে খুঁজে পাই—একসাথে আমরা মাতৃভূমির পক্ষে আওয়াজ তুলি।

অবশেষে আসে ৫ই আগস্ট—যেদিন ফ্যাসিস্ট শাসক দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়। তার আগের রাতে ‘ঢাকামুখী লংমার্চ’-এর ঘোষণা আসে, সঙ্গে সঙ্গে সরকার কারফিউ জারি করে। আমি রাত সাড়ে চারটা পর্যন্ত স্ক্রল করে খুঁজে গেছি কোনো আপডেট, কিন্তু কিছুই পাইনি।

সকাল সোয়া পাঁচটার সময় সোশ্যাল মিডিয়ায় ভিডিও আসা শুরু হয়—ছাত্র, অভিভাবক, নানা শ্রেণি-পেশার লাখ লাখ মানুষ ঢাকার দিকে এগিয়ে আসছে। আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না সেই অনুভূতি। মনে হয়েছিল, আমিও যেন ঢাকার রাস্তায় নেমে পড়েছি ভাই-বোনদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে।

আমরা যারা প্রবাসে আছি, হয়তো উন্নত জীবনের স্বপ্নে, নিরাপত্তার খোঁজে, কিংবা পরিবার-পরিজনের ভবিষ্যতের কথা ভেবে দেশের বাইরে পাড়ি জমিয়েছি, আমাদের হৃদয়ে দেশপ্রেমের জায়গা একটুও কম নয়। জুলাই বিপ্লবের সেই দিনগুলো আমাদের জন্যও ছিল দুঃসহ, দুশ্চিন্তা আর অসহায়ত্বে ভরা এক যুদ্ধ। দূরদেশে বসেও আমরা প্রতিটি খবরে কেঁপে উঠেছি, প্রতিটি মৃত্যু আমাদের ভিতরে রক্তক্ষরণ ঘটিয়েছে।

কিন্তু আমি এখনো বিশ্বাস করি—বাংলাদেশের নতুন প্রজন্ম, দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে থাকা আমাদের মতো মানুষরা, সম্মান, নৈতিকতা, সততা, দায়িত্ববোধ আর অন্যায়ের বিরুদ্ধে সাহসিকতায় একসাথে দাঁড়িয়ে একটি নতুন, ন্যায়ভিত্তিক বাংলাদেশ গড়ে তুলতে পারবে। সেই বাংলাদেশ একদিন গোটা পৃথিবীর সামনে একটি গর্বিত উদাহরণ হয়ে উঠবে।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।