Categories
প্রবাস সাক্ষাতকার

“ভয়ের সংস্কৃতি থেকে এখনও অনেক মানুষ বের হতে পারেনি”

ফ্যাসিবাদের আমলে বাংলাদেশে যে গুমের সংস্কৃতি তৈরি হয়েছিল তার বিচার করতে গত বছর বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করে গুম কমিশন। এই কমিশন এখন পর্যন্ত হাজার হাজার গুমের ঘটনা জানতে পেরেছে। সেই গুমের শিকার সাজেদুল ইসলাম সুমন, যাকে ২০১৩ সালের ডিসেম্বর মাসে নিরাপত্তা বাহিনী জোর করে তুলে নিয়ে যায়। এরপর আর ফেরেননি সুমন। তার বোন সানজিদা ইসলাম ভাইকে ফিরে পেতে গড়ে তোলেন মায়ের ডাক নামের একটি সংগঠন। তার সঙ্গে যোগ দেন গুমের শিকার হওয়া আরও অনেকের পরিবার। এক যুগ ধরে গুমের বিচার পেতে দেশ বিদেশে প্রচারণা চালিয়ে গেছে মায়ের ডাক। তাদের অব্যাহত চেষ্টার কারণে আন্তর্জাতিক মিডিয়া জানতে পারে ফ্যাসিস্ট হাসিনার সরকার কীভাবে বাংলাদেশে একটি ভয়ের সংস্কৃতি কায়েম করেছিল। সীমান্ত ম্যাগাজিনের পক্ষ থেকে মায়ের ডাক এর সমন্বয়ক সানজিদা ইসলাম এর কাছে আমরা জানতে চেয়েছিলাম সেই গুমের বিচার কতটুকু এগিয়েছে?

সানজিদা ইসলাম: আপনি জানেন আমার ভাই সহ যারা গত হাসিনা আমলে যে গুম হয়েছে তার বিচারের জন্য আমাদেরকে এক যুগেরও বেশি সময় রাজপথে থাকতে হয়েছে। গত জুলাইতে যে অভ্যুত্থান হয়েছে, যেটাকে বিপ্লব আমি বলি না, কারণ বিপ্লবটা এখনও শেষ হয়নি, তার পর থেকে এখন পর্যন্ত ১৭শ’ রও বেশি এপ্লিকেশন জমা পড়েছে গুম কমিশনে। তবে আমার মনে হয় আসল সংখ্যাটা আরও বেশি, কারণ বিগত আমলে যে ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি হয়েছিল তার থেকে এখনও অনেক মানুষ বের হতে পারেনি। সেসব গুমের ঘটনার তদন্তগুলো এখনও বিচারিক পর্যায়ে যায়নি। এই সংক্রান্ত আইনের সংস্কারগুলোও এখনও শেষ হয়নি। বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে যে হত্যাকাণ্ডগুলো হয়েছে যেমন শাপলা চত্বরে, বিডিআর বিদ্রোহ এর পাশাপাশি বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, সব মিলে এই সংখ্যাটা অনেক বড়। সেগুলোকে সুরাহা করার জন্য যথেষ্ট সামর্থ্য এবং জনবল মনে হয় না ট্রাইব্যুনালের আছে যদিও তদন্তকাজ চলছে। হাসিনা পালিয়ে গেছে কিন্তু তার প্রশাসনের লোকগুলো তো রয়ে গেছে। তারপরও আমরা চেষ্টা করছি সাক্ষ্য প্রমাণগুলো ঠিকঠাকমত যোগাড় করে ট্রাইব্যুনালে জমা দিতে।

©MayerDak

সীমান্ত: আপনারা এখন চেষ্টা করছেন বিচারিক কাজে সহায়তা করতে, কিন্তু মায়ের ডাক এর তো শুরু হয়েছিল একটি সামাজিক সংগঠন হিসেবে।

সানজিদা ইসলাম: আমরা এখন পর্যন্ত কাজ করেছি এই বিষয়ে সচেতনতা তৈরি করা এবং ইস্যুটাকে কীভাবে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে আসা যায়। এর পাশাপাশি গুমের শিকার হওয়া মানুষগুলোর পরিবারকে সহায়তা করা, কারণ তারা তো একটা ট্রমার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। দেখা গেছে একসঙ্গে থাকতে থাকতে এই পরিবারগুলোই এখন একটা যৌথ পরিবারের মত হয়ে গেছে। তাদেরকে সঠিকভাবে দিক নির্দেশনা দেওয়াটাও আমাদের একটা কাজ। এখন যেহেতু ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়েছে তাই আমরা বিচারিক প্রক্রিয়াতেও যুক্ত হচ্ছি।

সীমান্ত: সেক্ষেত্রে কি ট্রাইব্যুনাল তাদের কাজে আপনাদেরকে সম্পৃক্ত করছে?

সানজিদা ইসলাম: সাক্ষ্যপ্রমাণ এবং তথ্য যোগাড় করার ব্যাপারে তারা আমাদের কাছে জানতে চাচ্ছে। তবে তাদের কাজ বেশ ধীর গতির, আমরা যেরকম দ্রুততা আশা করেছিলাম সেটা হচ্ছে না। দেখা গেছে অনেক অভিযুক্ত ইতিমধ্যে দেশ ছেড়ে চলে গেছে।

সীমান্ত: গুমের শিকার পরিবারগুলোকে আপনার কীভাবে বিচারিক সহায়তা দেন?

সানজিদা ইসলাম: কমিশন যখন গঠিত হয় তখন আমাদের সঙ্গে দুইজন ভলান্টারি আইনজীবী ছিলেন তারা আমাদেরকে বিভিন্ন বিষয়ে গাইড করেছেন যেমন কী ধরণের কাগজপত্র জমা দিতে হবে যাতে করে কমিশনের তদন্ত কাজে সুবিধা হয়।

বিগত সরকারের আমলে আমরা রেজিস্ট্রেশন করতে পারিনি, এখন আমরা সাংগঠনিক কাঠামোর মধ্যে আসার চেষ্টা করছি। আমরা যদি বিচারিক উদাহরণ তৈরি করতে পারি তাহলে অন্যদেশের সংগঠন যারা মানবাধিকার ইস্যু নিয়ে কাজ করে তাদের সঙ্গেও একটা সহযোগিতা আমাদের গড়ে উঠবে।

সীমান্ত: আপনাদের কাজে প্রবাসীদের সম্পৃক্ততা কেমন?

সানজিদা ইসলাম: বিগত ৫ই আগস্টের আগে প্রবাসী তো পরে, আমাদের নিজেদের মধ্যেও যোগাযোগ রাখা সম্ভব ছিলো না। গুমের শিকার হওয়া পরিবারগুলোকে নিরাপত্তা বাহিনীর পক্ষ থেকে সারাক্ষণ নজরদারি করা হতো। এই অবস্থাতে প্রবাসীদের সঙ্গে কাজ করার উপায় আমাদের ছিল না। সবার মধ্যেই ভয় কাজ করতো কিছু বললেই হয়তো গুম করে ফেলা হবে। কিছু আন্তর্জাতিক মিডিয়া ছাড়া এই খবরগুলো আর কেউ প্রকাশ করতে পারেনি।

(ইন্টারভিউটি গত জুন মাসে নেয়া)

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।