“একদম শুরুতে আমি যখন কম্পিউটার বিক্রি করতে শুরু করি তখন অনেকেই আমাকে জিজ্ঞেস করেছে, তুমি কীভাবে কম্পিউটার বিক্রি করো, তোমার দেশে কি কম্পিউটার আছে?” জার্মানিতে নিজের ব্যবসার অভিজ্ঞতা এভাবেই তুলে ধরছিলেন মানহাইম শহরের প্রবাসী দেওয়ান শফিকুল ইসলাম।
জার্মানিতে যে দুয়েকজন প্রবাসী বাংলাদেশী সেই নব্বই দশকে নিজস্ব উদ্যোগ গড়ে তুলছিলেন দেওয়ান শফিকুল ইসলাম তাদেরই একজন। ব্যবসা ক্ষেত্রে সফলতার পাশাপাশি সামাজিক কর্মকাণ্ডেও ভীষণ ততপর তিনি। গত আড়াই দশক ধরে নিজস্ব প্রতিষ্ঠান সিএলএস কম্পিউটারকে গড়ে তুলেছেন তীলে তীলে। এখন মানহাইম শহরের অন্যতম কম্পিউটার প্রতিষ্ঠান এটি। কম্পিউটার ও নানা যন্ত্রাংশ বিক্রি ও মেরামতের পাশাপাশি সফটওয়্যারও তৈরি করছে তার প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশেও গড়ে তুলেছেন তার প্রযুক্তি ব্যবসা যেখানে কাজ করছে অর্ধশত তথ্য প্রযুক্তি পেশাজীবী।
বিগত ১৯৮৬ সালে জার্মানিতে আসেন দেওয়ান শফিকুল ইসলাম। তখন স্টুটগার্টের গোয়েথে ইন্সটিটিউটের ছাত্র ছিলেন। তারপর মানহাইমের বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার সায়েন্স পড়তে ভর্তি হন। তখন অবশ্য এই বিষয়টাকে বলা হতো ডাটেনটেখনিক যেটা পরবর্তীতে ইনফরমাটিক হিসেবে জার্মানির বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পরিচিতি লাভ করে। সে সময়রে কথা মনে করে তিনি বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় আমার নিজের একটা কম্পিউটার ছিলো যেটা খুব ধীর গতির ছিল। দ্বিতীয় সেমিস্টারে থাকতে আমি একটা পুরনো কম্পিউটার কিনে নিজেই কিছু ঠিকঠাক করে চালাতে শুরু করি। পঞ্চম সেমিস্টারে সেটি বিক্রি করে দেই। তারপর এভাবেই শুরু করি। পুরনো কম্পিউটার কিনে নিজে ঠিকঠাক করে বিক্রি করতাম। সপ্তাহে দুয়েকটা কম্পিউটার বিক্রি হতো। পড়াশোনা শেষ করার পর ভাবলাম আমি নিজেই একটা কোম্পানি দিলে কেমন হয়।”
তবে এর শুরুটা অত সহজ ছিল না। একে তো তিনি বিদেশী তার ওপর সেসময় নামকরা কম্পিউটার কোম্পানি ছিল হাতে গোনা। দেওয়ান শফিকুল ইসলাম বলেন, “প্রথম প্রথম অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে। কারণ ক্রেতারা সহজে বিশ্বাস করতে পারতো না যে আমার কাছেও ভালো কম্পিউটার পাওয়া যায়। মানুষের এই আস্থা অর্জন করতে আমার অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছে। ১৯৯৮ সালে বিল্ড পত্রিকার বার্ষিক জরিপে জার্মানির বিভিন্ন কম্পিউটার কোম্পানির মান তুলে ধরা হয়। সেখানে আমার সিএলএস কম্পিউটার খুব ভালো ফলাফল করে। কম্পিউটার প্রতিষ্ঠান হিসেবে সেটাই আমাদের প্রথম স্বীকৃতি। তারপর থেকে আমাদের ওপর ক্রেতাদের আস্থা অনেক বেড়ে যায়।”
জার্মানির তথ্য প্রযুক্তি খাতে এখন অনেক বাংলাদেশী প্রবাসী ঢুকে পড়ছে। প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকেও প্রচুর ছাত্রছাত্রী জার্মানির বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার সায়েন্স নিয়ে পড়তে আসে। জার্মানিতে তাদের সম্ভাবন কেমন হতে পারে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “ তথ্য প্রযুক্তি পেশাতে তিনটি খাত আছে। একটা হচ্ছে সার্ভিস। এখানে অনেক বড় একটা সম্ভাবনা আছে। এরপরে সফটওয়্যার খাতেও প্রচুর সুযোগ তৈরি হচ্ছে। অন্যদিকে হার্ডওয়্যার খাতে আপনাকে বিনিয়োগ করতে হবে। এছাড়া লাভের পরিমাণও এখানে অন্য দুই খাতের চেয়ে কম। “ তবে জার্মানিতে চাকরি কিংবা ব্যবসার করে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে জার্মান ভাষাটা জানা খুব প্রয়োজন বলে জানান দেওয়ান শফিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, “ভাষাটা ঠিকমত না জানার কারণে অনেক বিদেশী ছাত্রছাত্রীর সার্টিফিকেটের যথাযোগ্য মূল্যায়ন হয় না।”
ব্যবসার পাশাপাশি সামাজিক কর্মকাণ্ডেও প্রচুর সময় দেন দেওয়ান শফিকুল ইসলাম। মানহাইমের নতুন পুরনো সকল প্রবাসী বাংলাদেশীর কাছে পরিচিত মুখ তিনি। দলমত নির্বিশেষে সকলের সঙ্গে তিনি একসঙ্গে কাজ করতে চান। প্রবাসীদের সঙ্গে নিয়ে গড়ে তুলেছেন একটি ছোট্ট মসজিদও। ব্যক্তি জীবনে দুই মেয়ের বাবা তিনি। প্রবাসীদের মধ্যে তরুণদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, “ আমাদের উচিত প্রবাসীদের প্রথম প্রজন্মকে সম্মান করা, তাদের অবদানকে স্বীকার করা। কারণ তাদের সময়ে জার্মানিতে টিকে থাকাটা অনেক কঠিন ছিল। তারা জানতেন না তারা জার্মানিতে থাকতে পারবেন কিনা। এখন যারা নতুন আসছেন তাদের ভিসা পেতে অত সমস্যা হয় না। প্রবাসীদের প্রথম প্রজন্ম সংগ্রাম করে এদেশে টিকে ছিলেন, একটা জায়গা তৈরি করেছেন বলেই আজকে তরুণরা বাংলাদেশ থেকে সহজে জার্মানিতে চলে আসতে পারছে। ”
তবে শুধু চাকরি কিংবা ব্যবসা করেই প্রবাসীরা তাদের দায়িত্ব শেষ করতে পারবে না। তারা যে সমাজে বাস করছেন তার জন্যও প্রবাসী বাংলাদেশীদের অবদান রাখতে হবে। “আমরা সকলে যদি নিজের জায়গা থেকে অল্প হলেও অবদান রাখতে পারি তাহলে এই দেশ এগিয়ে যাবে আমাদের আমাদের নিজেদের দেশের মুখও উজ্জ্বল হবে।”, বলেন মানহাইমের প্রবাসী দেওয়ান শফিকুল ইসলাম।