টিনা আডোমাকোর বেড়ে ওঠা ঘানার রাজধানী আক্রা আর লন্ডন শহরে। পড়াশোনা করেছেন প্রথমে ইংরেজি সাহিত্য, ফরাসি এবং আফ্রিকান স্টাডিজ নিয়ে। তারপর জার্মানিতে ফ্রাইবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রোমান এবং জার্মান ইতিহাস নিয়ে পড়েছেন। পড়াশোনা শেষ করে জার্মানিতেই কয়েক বছর একাধিক প্রকাশনী এবং গণমাধ্যমে সাংবাদিক হিসেবে কাজ করেছেন। বিগত ২০১৬ সালে জার্মানির Eine Welt Netz এর বিশেষজ্ঞ পরামর্শক হিসেবে তিনি যোগ দেন ফোরাম ফর সোশ্যাল ইনোভেশন সংগঠনে। প্রবাসীদের সংগঠনগুলোকে একসঙ্গে নিয়ে নানা ধরণের কর্মশালা ও সেমিনারের আয়োজন করে থাকেন। পাশাপাশি এসব সংগঠনকে প্রশিক্ষণও দেন টিনা আডোমাকো। সীমান্ত ম্যাগাজিনের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে জার্মানির প্রবাসী সংগঠন এবং তাদের কর্মকান্ড, বর্ণবাদ সহ নানা বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন।
সীমান্তঃ আপনি দীর্ঘদিন ধরে সংবাদ জগতের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। আপনি কিভাবে উন্নয়ন নীতিমালার জগতে পাড়ি জমালেন। এক্ষেত্রে কোন বিষয়টি আপনাকে আগ্রহী করে তুলেছে?
টিনা আডোমাকোঃ ঠিক বলেছেন। আমি দীর্ঘদিন ধরে বড় বড় সংবাদ মাধ্যমে কাজ করেছি। সেগুলো ছিল বেশ উত্তেজনাকর এবং আনন্দদায়ক বছর। তবে সময়ের ব্যবধানে আমার কাছে মনে হয়েছে – আমার কাজের একটা তাৎপর্য থাকা জরুরি। তবে কর্পোরেট মিডিয়ার জগত থেকে ঘুরে দাঁড়ানোটাও একেবারে স্বেচ্ছা প্রণোদিত ছিল না। আমি তখন যে গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানে সম্পাদক হিসেবে কাজ করছিলাম, সেখানে কাঠামোগত সংস্কার চলছিল এবং যেকারণে অনেক সহকর্মীকেই তখন বাদ দেওয়া হয়েছিল। সেটা ছিল আমার জন্য একটা সুযোগ, আরও তাৎপর্যপূর্ণ কাজের জগতে প্রবেশ করার। তবে তার বেশ আগে থেকেই আমি উন্নয়ন জগতের সাথে জড়িত ছিলাম। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, যে আমি ঘানায় লেখাপড়া করার সময়েই শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধি নিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলাম। তখনও আমাকে বর্তমানের এসডিজি তথা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার বিষয়গুলি নিয়ে যেমন অধিকতর প্রতিনিধিত্ব, সমঅধিকার, ন্যায্য কর্মপরিবেশ – এসব উন্নয়ন নীতিমালা নিয়ে কাজ করতে হয়েছিল, যদিও আমি সেগুলোকে তখন ঠিক এমন পরিভাষায় চিনতাম না। যাহোক পেশা হিসেবে উন্নয়ন নীতিমালার জগতে প্রবেশ ঘটেছিল পুটুমাইয়ো ওয়ার্ল্ড মিউজিক এর সাথে কাজ করতে গিয়ে। এই প্রতিষ্ঠানটির লক্ষ্য ছিল – সংগীতের আন্তর্জাতিক এই ধারা আরও অনেক মানুষের কাছে পরিচিত করে তোলা। এছাড়া এই সংগীতের আসরগুলো থেকে লভ্যাংশের একটা অংক এই সংগীত ধারার মূল উৎস যে দেশে, সেদেশের উন্নয়নের জন্য দেওয়া হতো। এই প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রকাশনা ও প্রচারণার কাজ করতে গিয়ে মনে হয়েছে যে, একটা তাৎপর্যপূর্ণ কাজ করা হচ্ছে। সেই প্রতিষ্ঠান থেকে আইনে ভেল্ট নেৎস এ যোগ দেওয়াটা আমার জন্য সহজতর হয়েছিল।
সীমান্তঃ অভিবাসন বর্তমান বিশ্বে একটি বাস্তবতা এবং জার্মানি এই অভিবাসন প্রক্রিয়ার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আপনার মতে, অভিবাসী সংগঠনগুলো জার্মানির অভিবাসন নীতিমালায় কী ধরণের ভূমিকা রাখতে পারে?
টিনা আডোমাকোঃ জার্মানি অভিবাসী সমাজ নিয়েই গঠিত। এদেশে বসবাসকারী প্রতি তিনজনের একজন অভিবাসী। তবে এনআরডাব্লিউ প্রদেশের বড় বড় নগরীগুলোতে যেমন ডর্টমুন্ড, ড্যুসেলডর্ফ, কোলন এর অধিবাসীদের ৩৫ শতাংশই অভিবাসী। অভিবাসী সংগঠনগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সুশীলসমাজ, যাদের অধিকাংশই সাংস্কৃতিক, সামাজিক এবং শৈল্পিক বিভিন্ন ধারায় মূলতঃ স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে জড়িত – যা ইন্টেগ্রেশন এর ক্ষেত্রে অবদান রাখছে। এছাড়া শিক্ষাক্ষেত্রে টিউটরিং, প্রয়োজনীয় পরামর্শ এবং আরও বিভিন্নভাবে তারা সবার আরও অংশগ্রহণ এবং প্রতিনিধিত্বের ক্ষেত্রে এবং বিভিন্ন নীতিমালা নির্ধারণে এবং সুপারিশমালা প্রণয়নে অবদান রাখছে। এমন অনেক গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে তারা গোটা সমাজের সর্বস্তরে পারষ্পরিক সুসম্পর্ক বজায় রাখার কাজে ভূমিকা পালন করছে। এছাড়াও তারা নিজেদের মাতৃভূমিতে বিদ্যালয় ও হাসপাতাল নির্মাণ, যুব উন্নয়নমূলক প্রকল্পসহ নানা কাজে সহায়তা করছে।
সীমান্তঃ অভিবাসন নীতিমালা জার্মান গণমাধ্যমে একটি বহুল আলোচিত বিষয়। তবে অভিবাসী সংগঠনগুলোর কার্যক্রম নিয়ে এদেশের গণমাধ্যমে কদাচিৎ খবর প্রকাশিত হয়। এক্ষেত্রে গণমাধ্যমের আগ্রহ কম হওয়ার কারণ কী?
টিনা আডোমাকোঃ অভিবাসীদের ব্যাপারে প্রায়ই নেতিবাচক প্রসঙ্গ তুলে ধরা হয়। ইন্টেগ্রেশন বিষয়ক গণমাধ্যম সেবাসংস্থার জরিপে দেখা গেছে, টেলিভিশন এবং পত্রিকায় প্রকাশিত অভিবাসন বিষয়ক প্রতিবেদনের ২৫ শতাংশেরও বেশি তাদের উচ্ছৃংখলতা নিয়ে। আর যদি অভিবাসীদের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড সংক্রান্ত কোন খবর না থাকে তাহলে গণমাধ্যমগুলো অভিবাসনের সমস্যা এবং ঝুঁকি নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। আসলে অভিবাসী সংগঠনগুলোর ইতিবাচক কার্যক্রমের খবর জার্মান গণমাধ্যমের সাথে যায় না।
সীমান্তঃ শিশুদের এবং তরুণ-তরুণীদের মাঝে বর্ণবাদ বিষয়ে কিভাবে আরও সচেতনতা সৃষ্টি করা যেতে পারে?
টিনা আডোমাকোঃ শিশু-কিশোর এবং তরুণ-তরুণীরা যখন নিজেরা বর্ণবাদের শিকার হয়, তখন নিজেরা দ্রুতই ভাবতে থাকে যে, তারা কিছুটা ‘ভিন্ন’। তাই এটা গুরুত্বপূর্ণ যে, তাদেরকে আরও সচেতন এবং ক্ষমতায়ন করতে হবে, যাতে তারা জানতে পারে যে, এই বর্ণ বৈষম্যের মূল কোথায়, এটা হয়তো কাঠামোগত সমস্যা, যার জন্য তারা নিজেরা দায়ী নয়, এবং তারাই প্রথম এবং একমাত্র এই সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে না, তাদেরকে এই বৈষম্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে হবে এবং সমাজে কিছু মানুষ এব্যাপারে সোচ্চার আছে – যারা এরকম বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করে চলেছে। গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, তাদের সামনে ইতিবাচক উদাহরণ তুলে ধরা, যাতে করে তারা হীনমন্যতায় না ভোগে। সেজন্য তাদের নিজেদের জীবনচিত্র প্রতিফলিত হয় – এমন খেলনা সামগ্রী এবং বই-পত্র থাকতে হবে। এমন ধরণের সামগ্রী হয়তো খুঁজে পেতে কিছুটা সময় লাগে – তবে আছে যেমন অনলাইন শপ tebalou.de তে পাওয়া যায়। আরও গুরুত্বপূর্ণ হলো যে, ইতিহাস কিংবা গল্প বলার মধ্যে যে তথ্যগত ফাঁক রয়েছে – সেগুলো পূরণ করতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা হলো – শিশুরা যেন বর্জন, বর্ণবাদ কিংবা বৈষম্যের শিকার হওয়া নিয়ে দুশ্চিন্তার মধ্যে না থাকে। এসব পরিস্থিতির কারণে মূলত বর্ণবাদ এবং বৈষম্যমূলক ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে।
সীমান্তঃ আমরা কখনও এমনটি দেখি যে, একটি প্রবাসী সংগঠনের ভেতরেই কিংবা প্রবাসী সংগঠনগুলোর পরষ্পরের মধ্যেও বর্ণবাদমূলক আচরণ বিরাজ করে। আমরা কিভাবে এমন পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে পারি?
টিনা আডোমাকোঃ সংলাপ, সংলাপ, সংলাপ। বর্ণবাদ এবং উপনিবেশবাদের ইতিহাস এবং সঠিক ব্যাখ্যা তুলে ধরার কাজ থামিয়ে দেওয়ার কোন সুযোগ নেই। কারণ এর প্রভাব এককালে উপনিবেশ হিসেবে থাকা দেশগুলোর মধ্যে এখনও বিরাজ করছে। উপনিবেশ আমলে বিভিন্ন স্তরের মধ্যে ভেদাভেদ করা হয়েছিল – যেমন শুধুমাত্র নির্ধারিত বংশ, গোত্র, কিংবা জাতের (ভারত) সদস্যরাই উপনিবেশিক প্রশাসনে চাকুরী পেতো। এভাবেই উপনিবেশবাদের সমাপ্তি ঘটলেও এই রাজকীয় প্রথা থেকেই গেছে।